Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। এজন্য গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশ মূলত একটি রাষ্ট্রপতি আদেশ, যা বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে জাতীয় গণভোট আয়োজনের আইনগত কাঠামো নির্ধারণ করে দিবে। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন গত ২৫ নভেম্বর এই অধ্যাদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের পথ সুগম হলো।

সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে গেলে এবং জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। এই ক্ষমতার ভিত্তিতেই অধ্যাদেশটি প্রণয়ন হয়। অধ্যাদেশটি সরকারি গেজেটে প্রকাশের পরপরই কার্যকর হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে অধ্যাদেশটি প্রকাশ করা হয়।

এর উদ্দেশ্য জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন করা। সনদে ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করেছে। এতে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি, নির্বাহী ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রভাব এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা দেওয়া হয়।

অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য

গণভোট অধ্যাদেশের প্রধান লক্ষ্য হলো জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর বিষয়ে জনগণের অনুমোদন নেওয়া। বাধ্যতামূলক গণভোটের মাধ্যমে তা করা হবে। সনদটি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত সংস্কারের সারাংশ বহন করে। ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ প্রয়োগ করে।

গণভোটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে জনসমর্থন দিতে চায়। যদি জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়, তাহলে ভবিষ্যত নির্বাচিত সরকারগুলো এই সংস্কার বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে। এতে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমাত্রিক হতে পারে।

অন্যদিকে, যদি ‘না’ ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাব নাকচ হয়, তাহলে নির্বাচনে বিজয়ী দল সনদটি মানতে বাধ্য থাকবে না। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা আবারও বাড়তে পারে।

এই গণভোট বাংলাদেশে রাজনৈতিক রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হতে চলেছে। এর লক্ষ্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বা দুটি দলের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে তা দূর করতে একটি নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করা। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও তৈরি করতে পারে।

প্রধান বিধানসমূহ

অধ্যাদেশে গণভোট আয়োজনের জন্য একটি সরল ও স্পষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভুমিকায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কয়েকটি প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে গণভোটের বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত এ অধ্যাদেশ।

এতে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলো জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ রাখা হয়েছে। সেগুলো মানুষ সমর্থন করে কি না জানতে গণভোট আয়োজনের উদ্দেশ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে।

এতে মোট ২৩টি ধারা রয়েছে। অধ্যাদেশের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়, এই অধ্যাদেশ গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫ নামে অভিহিত হবে এবং অবিলম্বে কার্যকর হবে। ২ নম্বর ধারায় বিভিন্ন পরিভাষার অর্থ ও সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে।

গণভোট প্রশ্ন (ধারা ৩)

ভোটারদের সামনে একটি হ্যাঁ/না প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে। প্রশ্নটি হলো:

আপনি কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ এবং জুলাই জাতীয় সনদে থাকা নিম্নলিখিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সাথে একমত?

ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হইবে।

(খ) আগামী জাতীয় সংসদ হইবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হইবে এবং সংবিধান সংশোধন করিতে হইলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হইবে।

(গ) সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল হইতে ডেপুটি স্পীকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসহ তফসিলে বর্ণিত যে ৩০টি বিষয়ে জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্য হইয়াছে- সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকিবে।

(ঘ) জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অপরাপর সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হইবে।

এসব সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গড়ে তোলা, নির্বাহী ক্ষমতার আধিপত্য কমানো এবং রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতাকে উৎসাহ দেওয়া।

ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া (ধারা ৪–১০)

জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একীভূতকরণ: গণভোটে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একই ভোটকেন্দ্র, একই ভোটার তালিকা এবং একই কর্মকর্তা—যেমন রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা—ব্যবহার করা হবে। ভোটগ্রহণের সময়েরও সাধারণ নির্বাচনের সময়ের সঙ্গে মিল থাকবে।

ব্যালট ও পদ্ধতি: গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে। গণভোটের ব্যালটপত্র নির্বাচন ব্যালট থেকে আলাদা ও ভিন্ন রঙের হবে, যাতে কোনো বিভ্রান্তি না ঘটে। নির্বাচন কমিশন চাইলে যৌথ ব্যালট বাক্স ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরাও ভোট দিতে পারবেন।

ভোটগ্রহণে বিঘ্ন ও পুনরায় ভোট: কোনো অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলার কারণে ভোট স্থগিত হলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবেদন দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে পুনরায় ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবে।

১১ থেকে ২৩ নম্বর পর্যন্ত ধারাগুলোতে—ভোটাররা কীভাবে ভোট দেবেন, ব্যালট বাক্স, ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ, ভোট কেন্দ্রের শৃঙ্খলা রক্ষা ও নষ্ট বা বাতিল ব্যালট পেপার, ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ভোঠ গণনা, ফলাফল ঘোষণা, কমিশনের আদেশ জারি করার ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের পরিপত্র জারি করার ক্ষমতা, কমিশনকে সহায়তা প্রদান, অপরাধ, দণ্ড ও বিচার পদ্ধতি, দায়মুক্তি, বিধি প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ম বর্ণিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ইতোমধ্যে অধ্যাদেশটি অনুমোদন করেছে। এই উদ্যোগকে স্বৈরাচারী কাঠামো ভাঙার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ গণভোট দেশের রাজনীতিকে পুনর্গঠিত করতে পারে। আর প্রত্যাখ্যাত হলে রাজনৈতিক বিভাজন আরও তীব্র হতে পারে।

প্রভাব ও পরবর্তী ধাপ

গণভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে ভবিষ্যৎ সরকার প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে। এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। এখন নির্বাচন কমিশন ব্যালট প্রস্তুত এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ শুরু করেছে। এই গণভোটকে ঘিরে বিপুল ভোটার উপস্থিতি আশা করা হচ্ছে, কারণ এটি দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই গণভোট দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

গণভোট অধ্যাদেশ কেবল একটি আইনি কাঠামোর ঘোষণা নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথরেখায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বছরের পর বছর ধরে টানাপোড়েনে থাকা ক্ষমতার ভারসাম্য ও নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার বিপরীতে এটি জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র-সংস্কারের একটি বাস্তব সুযোগ তৈরি করেছে। জনগণ প্রথমবারের মতো সরাসরি সিদ্ধান্ত দেবে, কোন ধরনের রাজনৈতিক ভবিষ্যত তারা দেখতে চায়—অতীতের পুনরাবৃত্তি, নাকি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা।

এই গণভোটের মাধ্যমে শুধু জুলাই জাতীয় সনদের ভাগ্য নয়, বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটতে চায়—সেই দিকনির্দেশও নির্ধারিত হবে। ফলাফল যাই হোক, এটি দেশের গণতান্ত্রিক বিবর্তনের এক গভীর পরীক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠবে। এখন দায়িত্ব ভোটারের—তাদের রায়েই স্থির হবে রাষ্ট্রের কাঠামো, রাজনীতির ভবিষ্যৎ ও একটি বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সম্ভাবনা।