Image description

দেশে গত শুক্র ও শনিবার পর পর চার দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার কম্পন বিশেষ সতর্কবার্তা দিয়ে গেছে। দেশজুড়ে এখন আতঙ্ক। বিশেষ করে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বহুতল ভবনে থাকা মানুষজন চরম ঝুঁকি অনুভব করছেন।

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হলে উদ্ধার তৎপরতার প্রথম সারিতে থাকার কথা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও জেলা প্রশাসনের। প্রশ্ন উঠছে সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলায় এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কি যথেষ্ট?

তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, এই বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। ভূমিকম্প-সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি জয়েন্ট মিটিং করা হবে এবং করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হবে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ কাজ করার কথা জানিয়েছে রাজউক।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অভিজ্ঞ জনবল এবং যন্ত্রপাতি রয়েছে তাদের। তবে সক্ষমতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। তবে ভূমিকম্পে বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি হলে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। সম্মিলিতভাবে সব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি।

জানা গেছে, রাজধানীতে সাড়ে ২১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ একত্রে করতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে। কেননা, ভবনে থাকা গ্যাসের লাইন ফেটে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। রাজধানীতে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে মাত্র ১৮টি। এসব স্টেশনে যে জনবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে—তা দিয়ে একযোগে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি ধসে পড়া ভবনে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে। আর ভবন ধসে সড়ক বন্ধ হয়ে গেলে ফায়ার সার্ভিসের চলাচলের সক্ষমতাও বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে দেশবাসীর মাঝে মহা এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, যেকোনও বড় ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তা মোকাবিলায় সারা দেশে ১৪ হাজার ৫৬০ জনের জনবল রয়েছে তাদের। এছাড়া রয়েছে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। যদিও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে সব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে হবে।

বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি কেমন—জানতে চাওয়া হলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ভূমিকম্প আর অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতির ধরন একটু ভিন্ন। ভূমিকম্প হলে সাধারণত ভবন বা স্থাপনা ধসে পড়ার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার জন্য অগ্নিনির্বাপণের মতো বড় গাড়ি-পাম্প ব্যবহার করা যায় না। ছোট ছোট যন্ত্রপাতি—যেগুলো হাতে বহন করা যায়, সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। এ ধরনের যন্ত্রপাতি ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা তুরস্ক ও মিয়ানমারে ভূমিকম্পে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কাজেই আমাদের অভিজ্ঞ জনবল এবং যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে আমরা সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। এটা সত্য যে ভূমিকম্পে বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি হলে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা তৈরি  হতে পারে। সম্মিলিতভাবে সব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে ঢাকার পূর্বাচল ও বিভাগ পর্যায়ে স্পেশাল রেসকিউ টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরির টার্গেট নিয়ে ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি প্রয়োজনে তারাও আমাদের পাশে এসে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করবেন।’’

তিনি জানান, এছাড়া অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়েছে যেন একটি ভবন ভেঙে পড়লে সব কর্মকর্তা আটকে না যান, কমান্ড ফেল না করে।

শাহজাহান সিকদার বলেন, ‘‘জেলা পর্যায়সহ আমাদের সব স্টেশনে ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ করার মতো ইকুইপমেন্ট রাখা আছে। তবে একটা মেগা ডিজাস্টার হলে সেটি মোকাবিলা জন্য আমাদের দেশের যে এসওডি আছে (স্ট্যান্ডার্ড অর্ডার অ্যান্ড ডিজাস্টার) তার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করবো।’’

  

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমরা সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজউক এবং ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি জয়েন্ট মিটিং করবো। সেই মিটিংয়ে রাজধানীতে ভূমিকম্প হলে কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করবো। এছাড়া ভূমিকম্প হলে যেন সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত না হয়—সেজন্য জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করবো।’’

ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘‘গত দুদিন আগের যে ভূমিকম্প, তার দায়িত্ব কম থাকলেও তীব্রতা ছিল ব্যাপক। ভূমিকম্পের ফলে মানুষ ছোটাছুটি করেন। যার ফলে অনেকে আহত হন। ভূমিকম্প হলে করণীয় কী—তার প্রচার-প্রচারণা আমরা করবো। আর সিটি করপোরেশন এলাকায় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে, সেসব বিষয়ে রাজউকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।’’

যা বলছে রাজউক

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘‘বিগত সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিরসনে নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হলেও জননিরাপত্তার স্বার্থে এবার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিরসনে কাজ করা হবে। রাজধানীতে বিশেষ করে পুরান ঢাকার বেশিরভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা পূর্বের তালিকা অনুযায়ী এবং নতুন কমিটি গঠন করে পুনরায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো।’’

রাজউক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘কোনও প্ল্যান ছাড়া এক কাঠার কম জমিতে রাজধানীর অনেক জায়গায় ৬-৭ তলা বাড়ি আছে। সেসব বাড়ির কিন্তু অনুমোদন পর্যন্ত নেই। ঠিকমতো সেফটি মেনটেন করে সেসব বাড়ি নির্মাণ করা হয়নি। আমরা এক কাঠার নিচে কোনও প্ল্যান দিই না। যারা জোর করে করতেছে, আমরা তাদের মিটার কেটে দিচ্ছি। তারপরও আবার চোরাই মিটার নিয়ে বা জেনারেটর দিয়ে তারা করতেছে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু কাজ করবো।’’

জেলা প্রশাসনের বক্তব্য

ভূমিকম্পের চলমান যে আতঙ্ক এবং এর যে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে—সে সম্পর্কে জেলা প্রশাসন সতর্ক আছে কিনা, জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার সালাউদ্দিন ওয়াদুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমরা যে সতর্ক আছি তার প্রমাণ হচ্ছে—ভূমিকম্প হওয়ার খবর জানা মাত্রই আমরা জরুরি সহায়তা দেওয়ার জন্য কন্ট্রোল রুম খুলেছি।’’