পুরান ঢাকার নিম্ন আদালত সংলগ্ন হাজতখানার সামনে তখন বেশ কিছু মানুষের ভিড়। সকলেই হাজতে থাকা আসামিদের স্বজন। অনেকে গেটের ফাঁক দিয়ে উকিঝুঁকি মেরে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছিলেন।
গত ১০ই নভেম্বর সোমবার দুপুরে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানার সামনে এমন চিত্রই দেখা যায়।
এর মধ্যেই দুপুরের দিকে হঠাৎ গেট খুলে যায়। দেখা যায় কয়েকজন নারী পুলিশ একজন বৃদ্ধাকে ঘিরে ধরে নিয়ে আসছেন। সামনে-পেছনে আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও দেখা গেলো।
এই বৃদ্ধাই সখিনা বেগম যাকে কয়েকমাস আগে ভারতের আসাম থেকে ধরে নিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় ভারতের সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএএসএফ।
হাজতখানার গেট দিয়ে যখন সখিনা বেগমকে বের করা হচ্ছিল, তখন তিনি ছিলেন একেবারেই চুপচাপ। দুজন নারী পুলিশ সদস্য তার হাত ধরে ছিলেন। বৃদ্ধার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকালেন। বাইরে বের হতেই মানুষের হইচই আর টিভি ক্যামেরা দেখে কিছুটা যেন হতবিহ্বলও মনে হলো তাকে।
কেমন আছেন এমন প্রশ্নে দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠে অসমীয়া ভাষায় জানালেন, ‘অসুস্থ হয়েছিলাম, এখন ঠিক আছি।’ বাকি কথা আর শোনা গেলো না। ততক্ষণে পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘিরে আড়াল করে ফেলেছেন। সখিনা বেগমকে এদিন আদালতে আনা হয়েছিলো জামিন শুনানির জন্য। দিনটা ছিল ১০ই নভেম্বর সোমবার।
সখিনা বেগমকে সাড়ে পাঁচ মাস আগে গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে আটক করেছিল ভারতের আসাম পুলিশ। তখন তাকে আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুড়া গ্রামের বাসা থেকে পুলিশ নিয়ে যায়। এরপর তাকে হস্তান্তর করা হয় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছে। কিন্তু পরিবারকে কিছুই জানানো হয়নি। খবর বিবিসি বাংলা।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সখিনা বেগমকে বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুরে খুঁজে পাওয়া যায়। আটষট্টি বছরের এই বৃদ্ধা তখন জানিয়েছিলেন, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে।
বৃদ্ধার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী ভারতের আসামে গিয়ে সখিনা বেগমের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওকলে সখিনা বেগমের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা কথা বললে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু সখিনা বেগমের ঘটনা পুলিশ জানতে পারলে তারা বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। সখিনা বেগমকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় মিরপুরের ভাষানটেক থানা পুলিশ।
যেহেতু পাসপোর্ট কিংবা বৈধভাবে প্রবেশের কোনো নথিপত্র ছিল না সখিনা বেগমের কাছে, তাই বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা দেয় পুলিশ। পরদিন আদালতে তোলা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। শুরু হয় সখিনা বেগমের জেল জীবন।
সখিনা বেগমকে ঢাকায় মিরপুরের রাস্তায় অসহায় অবস্থায় পাওয়ার পর আশ্রয় দিয়েছিল মিরপুরের একটি পরিবার। সেই পরিবারের সদস্য ক্লান্তি আক্তার বলেন, পুলিশ যখন ঐ বৃদ্ধাকে নিয়ে যায় তখন বৃদ্ধা তাদের ছাড়তে চাচ্ছিলেন না।
তিনি বলেন, ‘উনি (সখিনা বেগম) কোনোভাবেই যেতে চান নাই। উনি ভয় পাচ্ছিলেন। আমাদের জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছেন। পরে অনেক বুঝিয়ে তাকে পুলিশ সঙ্গে নিতে পেরেছিল।’
জামিন শুনানির কী হলো?
গত সোমবার যখন ভারতীয় ঐ বৃদ্ধাকে আদালতে তোলা হয় জামিন আবেদন শুনানির জন্য তখন আদালতে এসেছিলেন ক্লান্তি আক্তার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঐ বৃদ্ধার সঙ্গে কথাও বলতে পারেন।
‘উনাকে দেখে একটু অসুস্থ মনে হচ্ছে। মাঝখানে তার মুখে ঘা হয়ে যায়, জ্বরও ছিল। সেগুলো এখন ভালো হয়েছে। তবে একটু দুর্বল মনে হলো। উনি আশা করে আছেন যে আজকে উনার জামিন হবে। আমরাও অনেক আশা নিয়ে এসেছি, বলেন ক্লান্তি আক্তার।
দুপুর একটার পরে মহানগর হাকিম আদালতে শুনানি শুরু হয়। প্রায় বিশ মিনিট শুনানি শেষে সখিনা বেগমকে আবারো নিয়ে যাওয়া হয় হাজতখানায়।
তবে শুনানি শেষ হলেও আদালত তাৎক্ষণিক কোনো আদেশ দেননি।
সখিনা বেগমের আইনজীবী রহমাতুল্যাহ সিদ্দিক বলেন, ‘আদালত সব শুনেছেন। কিছু প্রশ্নও করেছেন। আমরা জামিন চেয়েছি। আর যদি জামিন সম্ভব নাও হয়, সেক্ষেত্রে তাকে যেন সরকারি কোনো সেফ হাউজে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, যেহেতু তিনি বয়স্ক, বৃদ্ধা নারী- এটা আদালতে বলেছি। আদালত পরে আদেশ দেবেন।’
শেষপর্যন্ত ঘণ্টাদুয়েক পরে আদেশ হয়। আদেশে জামিন নাকচের কথা বলা হয় বলে জানান, সখিনা বেগমের পক্ষের আরেক আইনজীবী শরীফুল ইসলাম।
‘উনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা আনা হয়েছে যে, উনি ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া অবস্থান করার যে অপরাধ এটা জামিনযোগ্য,’ বলেন সখিনা বেগমের আইনজীবী শরীফুল ইসলাম।
কিন্তু তাহলে জামিন হলো না কেন এমন প্রশ্নে আদালতের যুক্তি তুলে ধরেন শরীফুল বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত এখানে যুক্তি দিয়েছেন যে, যদি আসামিকে জামিন দেয়া হয়, আসামি তো ভারত থেকে এসেছে। সে যদি ভারতে চলে যায় তাহলে তার মামলা চলছে, এটার ট্রায়াল প্রসিডিউর কী হবে?’ জামিন হয়নি শুনে ভারতে অঝোরে কাঁদলেন সখিনা বেগমের মেয়ে
ঢাকায় যখন শুনানি চলছিলো, তখন এর ফল জানার আশায় ভারতের আসামে নিজ বাড়িতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সখিনা বেগমের মেয়ে রাসিয়া বেগম।
একইসঙ্গে মাকে দেখার আকুতি থেকে ‘আবদার’ করেছিলেন, মায়ের একখানা ছবি বা ভিডিও পাঠানোর জন্য। পরে হোয়াটসঅ্যাপে তাকে আদালতের ভিডিও পাঠানো হয়। যে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিলো সখিনা বেগমকে পুলিশ সদস্যরা কোর্টে নিয়ে যাচ্ছেন।
বৃদ্ধা মাকে ভিনদেশের পুলিশের হাতে আটক অবস্থার দৃশ্য দেখে রাসিয়া বেগমের কান্না যেন থামছিলো না।
ভিডিওতে কেমন আছেন এমন প্রশ্নে সখিনা বেগম যখন বলেছিলেন, ‘অসুস্থ হয়েছিলাম, এখন ঠিক আছি।’ তার মেয়ে রাসিয়া বেগম এই বাক্যটি শুনে চোখ মুছতে থাকেন।
‘ওহ... মা অসুস্থ হয়েছিলো? যাক এখন ঠিক আছে জেনে নিশ্চিন্ত হলাম।’
কিন্তু কিছুক্ষণ পর জামিন নাকচ হবার কথা শুনে আরেক দফা কাঁদলেন রাসিয়া বেগম।
বললেন, মায়ের মৃত্যুর আগের এই শেষ সময়টায় তার সেবা করার সুযোগ চান।
‘এই বৃদ্ধ বয়সে যদি উনার সেবাযত্ন করতে না পারি, তাহলে এই কষ্ট কোথায় রাখবো? আমরা দুই সরকারকে অনুরোধ করছি, তারা যেন যেভাবেই হোক, আমার মাকে দেশে ফিরিয়ে আনে। আমি হাতজোড় করে দুই সরকারকে অনুরোধ করছি, তার এই শেষ বয়সে যেন তার সেবাযত্ন করতে পারি। মা ছাড়া তো আমাদের আর কেউ নেই।’
হাত জোড় করে বলছিলেন রাসিয়া বেগম। তবে তিনি এটাও জানান, ভারতে মামলা চালানো বা বাংলাদেশে মামলার খরচ করার মতো সামর্থ্য তার নেই।
তবে সখিনা বেগমকে ভারতে ফিরিয়ে আনতে আসামের বড়োল্যান্ড স্বশাসিত এলাকার সংখ্যলঘু মুসলিম ছাত্রদের একটি সংগঠন অল বিটিসি মাইনরিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এ বিষয়ে ভারতের আদালতে মামলা করবেন তারা।
সংগঠনিটর প্রেসিডেন্ট টাইসন হোসেইন জানিয়েছেন মামলার সকল প্রস্তুতি তারা নিয়েছেন।
‘সখিনা বেগমের বিষয়টি, কী করে তাকে আসামে তার বাড়িতে ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি প্রস্তুতি আমরা নিয়ে ফেলেছি। আমরা তার পরিবারকে দিয়ে গুয়াহাটি হাইকোর্টে হিবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করাবো। সেখানে যদি আশানুরূপ রায় না পাই, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাব। সখিনা বেগমের মামলা নিয়ে দরকার পড়লে আমরা আন্তর্জাতিক আদালত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত যাব’ বলেন টাইসন হোসেইন।
এদিকে বাংলাদেশের আইনজীবীও জানিয়েছেন, সখিনা বেগমের জামিন আবেদন নিয়ে এখন তারা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে নতুন করে আবেদন করবেন।
ততদিনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন সখিনা বেগমকেও থাকতে হচ্ছে ভিনদেশের কারাগারে অচেনা পরিবেশে।
এমনকি জামিন যদি হয়েও যায় তারপরও তিনি কবে দেশে কবে ফিরতে পারবেন সেটাও নিশ্চিত নয়।