দীর্ঘদিন ধরে বেতন-ভাতা না পাওয়া বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন ১৯ দিন ধরে; দাবিদাওয়ার ব্যাপারে অনড় থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন তারা।
শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্তির ‘আশ্বাস’ তারা পেয়েছেন। তবে ‘সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত’ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
আর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ‘প্রস্তুতি’ শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ‘নীতিমালা সংশোধন’ ও ‘আবেদন গ্রহণের সফটওয়্যার হালনাগাদ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আবেদন শুরুর ঘোষণা চান শিক্ষকরা
‘ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে গত ৩ নভেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। বৃহস্পতিবার দুপুরেও তারা কর্মসূচি পালন করেন।
এদিন ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মুনিমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আবেদন শুরুর ঘোষণা আসা পর্যন্ত তারা ক্লাসে ফিরবেন না।
“সর্বশেষ আমাদের দাবি নিয়ে গত মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে উপদেষ্টা (শিক্ষা) মহোদয় বৈঠক করেছেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্তির দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে সেই ২০১৮ সাল থেকে এ আশ্বাস আমাদের দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আশ্বাস নয়, আমরা চাই এমপিওভুক্তির ঘোষণা। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়ে সরকারে লিখিত ঘোষণা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরব না। এমপিওভুক্তির আবেদন শুরু করা পর্যন্ত, অন্তত আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাব।”
এর আগে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পদযাত্রা নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। পরে জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
অধ্যক্ষ মুনিমুল হকের বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ আমাদের কোনো কঠোর কর্মসূচি আপাতত ঘোষণা না করার অনুরোধ করেছে, এদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও আলোচনা চলছে। সে অনুযায়ী আমরা অবস্থান কর্মসূচি চালাচ্ছি।
“গত রোজার মাসে এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১৭ দিনের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালনের পর মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিব মহোদয় শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা না পেয়ে ননএমপিও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সরকারকে এমপিও নীতিমালা ও পরিপত্রের অসম খেলা বন্ধ করে সব ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার আহ্বান জানাই। তা নাহলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা দাবি আদায় করব।”
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকরা। ১৭ দিন অবস্থানের পর গত ১২ মার্চ তারা শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
সেদিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক সেলিম মিয়া এমপিওভুক্তির বিষয়ে ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় আশ্বাস পাওয়ার কথা’ তুলে ধরে কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপর ফের ২ নভেম্বর থেকে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তারা।
শিক্ষকদের দাবির আলোচনায় রাজনৈতিক নেতারাও
দীর্ঘদিন বেতন-ভাতার বাইরে থাকা ননএমপিও শিক্ষকদের দাবি পূরণে উদ্যোগী হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারাও। মঙ্গলবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরারের সঙ্গে আলোচনা করেন।
শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূইয়া, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের আহ্বায়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সহ-সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির শিক্ষা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ওমর ফারুক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মো. ফয়সালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ওই সভায় অংশ নেন।
বৈঠকের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা খালিদ মাহমুদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সভায় শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এমপিওভুক্তকরণ প্রক্রিয়া, নীতিমালা, বাস্তবায়ন কৌশল ও সরকারের চলমান পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষা উপদেষ্টা বৈঠকে রাজনৈতিক নেতাদের এমপিও নীতিমালার বর্তমান অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা তুলে ধরে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার ‘একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত এমপিও প্রক্রিয়া’ বাস্তবায়নে সরকারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। রাজনৈতিক নেতারা ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়ন এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করতে’ সরকারকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি
নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সফটওয়্যার হালনাগাদ করছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো-ব্যানবেইস। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এমপিও নীতিমালায় ‘নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি শর্তে’ কিছুটা পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া চলছে।
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক-২ বা বেসরকারি মাধ্যমিক শাখা এমপিও সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করছে।
এ শাখার উপসচিব সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলী বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এমপিও নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। নীতিমালায় নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির শর্তে কিছুটা পরিবর্তন আনছে। এজন্য বিদ্যমান নীতিমালায় নতুন করে কয়েকটি সূচকের পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
“সংশোধিত নীতিমালাটি আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর পরিবর্তন হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।”
সফটওয়্যার হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন নিয়ে আগামী সোমবার ব্যানবেইস একটি সভা ডেকেছে জানিয়ে উপসচিব বলেন, “এটি একটি টেকনিক্যাল সভা। আগের সফটওয়্যারটি হালনাগাদকরণ ও পরিবর্তিত সূচকগুলো অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ওই সভায় আলোচনা হওয়া কথা আছে।”
আগামীতে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।