
রাজধানীর কারওয়ান বাজার সিগন্যালের ঠিক আগে একটি বাস এসে দাঁড়াল। মিরপুর থেকে আসা বাসটির নাম ‘তানজিল পরিবহন’। এর ঠিক আগে হঠাৎ করেই বাসটির হেলপার (চালকের সহযোগী) চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ওস্তাদ, পিছনে নাম্বার!’ সঙ্গে সঙ্গে চালক বাসটি সড়কের ওপর কিছুটা আড়াআড়ি করে রাখল। উদ্দেশ্য, পেছনের একই নামের বাস (তানজিল পরিবহন) যেন তাকে ওভারটেক করে যেতে না পারে এবং অপেক্ষমাণ যাত্রীদের যেন তার বাসেই তুলতে পারে। ফলে পেছনে তাৎক্ষণিক যানজট সৃষ্টি হয়ে গেল।
একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর উত্তর বাড্ডা ফুটওভার ব্রিজের নিচের প্রধান সড়কে। সেখানেও কিছুটা আড়াআড়িভাবে ‘ভিক্টর ক্লাসিক’ নামের একটি বাস রাখেন চালক। পেছনে আরও দুই-তিনটি ভিক্টর ক্লাসিক বাস, তারা যেন সামনে থাকা বাসটিকে অতিক্রম করার সুযোগ না পায়।
বাসে উঠে কথা হয় তরুণ চালক হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দেন, “পিছনে ‘নাম্বার’, তাই অল্প সময়ের জন্য বাসটা এভাবে রেখে পাশ কাটিয়ে টান দিয়েছি। যেন পিছনের ‘নাম্বার’ আমাকে ওভারটেক করতে না পারে।”
রাজধানীর সব রুটেই চলাচলকারী বাসগুলো হঠাৎ হঠাৎ আড়াআড়িভাবে সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখে। সব সড়কেই একই নামে আলাদা আলাদা মালিকের বাস রয়েছে। যেমন— ভিক্টর ক্লাসিক বাস, আকাশ সুপ্রভাত, রাইদা— এগুলো একই রুটে চলে। একই নামের এমন বাসের সংখ্যা ১০০টিরও বেশি। যেগুলোর প্রতিটি আলাদা আলাদা মালিকের। একই নামের বাসকে সাংকেতিক ভাষায় ঢাকা হয় ‘নাম্বার’। মানে— এগুলো একই রুটের প্রতিযোগী বাস
বাসটি চলতে চলতে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় হেলপার ফরিদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, “রাজধানীর সব রুটেই বাসগুলো হঠাৎ হঠাৎ এমন আড়াআড়িভাবে সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখে। সব সড়কেই একই নামে আলাদা আলাদা মালিকের বাস রয়েছে। যেমন— ভিক্টর ক্লাসিক বাস, আকাশ সুপ্রভাত, রাইদা— এগুলো একই রুটে চলে। একই নামের এমন বাসের সংখ্যা ১০০টিরও বেশি। যেগুলোর প্রতিটি আলাদা আলাদা মালিকের। আমাদেরটা যেমন ভিক্টর ক্লাসিক বাস, এই নামেরই আলাদা আলাদা মালিকের আরও ১০০টি বাস আছে। আমরা এসব একই নামের বাসকে সাংকেতিক ভাষায় বলি ‘নাম্বার’। মানে— এগুলো একই রুটের প্রতিযোগী বাস।”

সড়কের মাঝে আড়াআড়িভাবে বাস রাখার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, “পেছনে ‘নাম্বার’ গাড়ি দেখলে চালককে আমরা সতর্ক করে বলে দিই— ‘ওস্তাদ, পিছনে নাম্বার।’ তখন চালক গাড়িটি একটু ডানে বা বামে ক্রস করে দেয়। যেন পেছনের ‘নাম্বার’ গাড়িটি আমাদের অতিক্রম করে যেতে না পারে। যেহেতু একই রুটের বাস, তাই বাসটি ওভারটেক করে সামনে গেলে, সামনের সব যাত্রী তারা নিয়ে নেবে। সে কারণে আমরা চেষ্টা করি যেন পেছনের ‘নাম্বার’ গাড়িটি আমাদের অতিক্রম করে যেতে না পারে, আর সামনের যাত্রীগুলো যেন আমরাই পাই।”
এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের এমন রেষারেষি এবং আগে যেতে না দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ‘রাইদা’ পরিবহনের চালক আব্দুল মালেক বলেন, “বাস-মালিকের কাছ থেকে আমরা প্রতিদিন জমা-খরচ দিয়ে সারাদিনের জন্য বাস নিয়ে সড়কে নামাই। প্রতিদিনের জন্য বাসপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ আছে, যা মালিককে দিতে হয়। এরপর আছে রাস্তা খরচ, মানে বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। এরপর যে টাকা থাকবে, তা দিয়ে তেল খরচ এবং আমাদের বেতন। এমনও দিন আছে যখন জমা-খরচের টাকাও তুলতে পারি না।”

“এ কারণে সব চালকই চায় যেন একই ‘নাম্বার’-এর গাড়ি তার আগে যেতে না পারে। সে কারণেই মাঝে মাঝে চলার পথে সড়কের মাঝে আড়াআড়িভাবে বাস রেখে দেওয়া হয়। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়, এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ঘষাঘষি হয়। যদিও মাঝে মাঝে এ কারণে ট্রাফিক পুলিশের মামলা খেতে হয়। আসলে ঢাকার সড়কে বিষয়টি একটি প্রচলিত প্রথায় পরিণত হয়েছে।”
যা বলছেন সাধারণ ভুক্তভোগীরা
বিষয়টি নিয়ে রাইড শেয়ার করা মোটরসাইকেলের চালক সবুজ আহমেদ বলেন, ঢাকার প্রতিটি বড় সড়কে হঠাৎ হঠাৎ আড়াআড়িভাবে বাস রেখে পেছনের যানবাহনগুলোকে আটকে দেওয়া হয়। ফলে পেছনের গাড়িগুলো আর সামনে এগোতে পারে না, সৃষ্টি হয় যানজট। প্রতিদিনই এমন ঘটনা দেখি অহরহ। এসব চালকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলে যানজট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। তাদের এমন অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণেই সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
একই ধরনের অভিযোগের কথা জানিয়ে ‘ওয়েলকাম’ পরিবহনের যাত্রী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘চালকদের এমন প্রতিযোগিতার কারণে বাসে উঠতেও ভয় লাগে। একে-অপরকে ওভারটেক করার চেষ্টা, একই পরিবহনের অন্য গাড়িকে সাইড না দেওয়া, রেষারেষি করে গাড়ি চালানো, পেছনের গাড়িকে আটকে দেওয়া— এসব কারণেই দুর্ঘটনার পাশাপাশি তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে রেষারেষির কারণে এর আগে কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবরও আমরা জানি। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের তো করার কিছুই থাকে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শুধু চাওয়া, সড়কের শৃঙ্খলা যেন ফিরে আসে, আমরা যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারি।’
ব্যস্ত সড়কে আড়াআড়িভাবে বাস রেখে যানজট সৃষ্টির বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি সড়কেই এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা নিয়মিত মামলা দিয়ে চালকদের সংশোধন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা কিছুই মানতে চাচ্ছেন না। একটি সিগন্যালে দু-একজন ট্রাফিক পুলিশ থাকেন। দেখা যায়, একজন চালককে মামলা দেওয়া হলো, অথচ একই সময়ে আরও কয়েকজন চালক এমনটি করে ফেলেছেন। সেক্ষেত্রে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন? চালকরা যদি নিজ থেকেই সচেতন না হন, তাহলে এমন পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাস-মালিকদেরও এ বিষয়ে দায়বদ্ধতা আছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে আরও কঠোর হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ঢাকা শহরে যানজটের কুফল
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার যানজট প্রতি বছর অর্থনীতিতে ৩৭ হাজার কোটি থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা (৩.৫ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতি করে। এটি জিডিপির ৫ থেকে ১০% হারানোর সমান।
শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, যানজটের স্বাস্থ্যঝুঁকিও মারাত্মক। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে যানবাহনজনিত বায়ুদূষণ বাংলাদেশে ৭৮ হাজার থেকে ৮৮ হাজার মানুষের অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল, যা জিডিপির প্রায় ৪% ক্ষতির সমান। গড় গতির কথা ভাবলে দেখা যায়, এক দশক আগে যেখানে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ২১ কি.মি./ঘণ্টা, আজ তা নেমে এসেছে ৪.৫ কি.মি./ঘণ্টায়।

কেন এমন যানজট
ঢাকার সড়ক অবকাঠামো বর্তমান জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল ও পুরোনো। শহরের রাস্তা মোট ভূমির মাত্র ৭-৮ শতাংশজুড়ে রয়েছে, যেখানে আদর্শ শহরের জন্য এটি কমপক্ষে ২৫ শতাংশ হওয়া উচিত। অধিকাংশ রাস্তা সরু, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে সড়কগুলো। এছাড়া, চলমান অবকাঠামোগত প্রকল্প যেমন- ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ সড়কগুলোকে আরও সংকোচিত করেছে। ফলে, যানজট আরও তীব্র হচ্ছে।
যানজট পরিত্রাণে করণীয়
যানজটের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণে করণীয় শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’। সেখানে রাজধানী ঢাকার যানজটের বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০০৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৮ কিলোমিটারে। ঢাকায় যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে দৈনিক প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। অর্থমূল্যে যা দৈনিক প্রায় ১৩৯ কোটি এবং বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক।

যানজটের এই সমস্যার জন্য শৃঙ্খলা না মেনে গাড়ি চালানো, রাজধানীর বিভিন্ন ব্যস্ত সড়কে মেগা প্রকল্পগুলোর কালক্ষেপণ, ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর পরিকল্পনা, দুর্বল ট্রাফিক সিগন্যাল ও মনিটরিং ব্যবস্থা, যানবাহন নিবন্ধনে অব্যবস্থাপনা, সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতির অভাবসহ বেশকিছু কারণ দায়ী। এ বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সমাধান করা গেলে সড়কে ফিরতে পারে গতি ও শৃঙ্খলা— মনে করেন সাইফুদ্দিন আহমেদ।