
বর্ধিত ট্যারিফ ইস্যুতে চট্টগ্রাম বন্দরে সৃষ্ট ভয়াবহ সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা। বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ইতোমধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরাম’ প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরসহ নানা ব্যস্ততার কারণে এ ক’দিন প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যুতে মনোযোগ দিতে পারেননি বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের প্রত্যাশা-অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখতে এবার তিনি মনোযোগ দেবেন। চট্টগ্রামের সন্তান হিসাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও (চবক) বলছে, যে ট্যারিফ কার্যকর হয়েছে তা বাতিল, সংশোধন কিংবা স্থগিত করতে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। এখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো কিছু করার সুযোগ বা এখতিয়ার নেই।
এদিকে সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারীদের প্রবেশ ফি ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৫ টাকা (ভ্যাটসহ) নির্ধারণ করার প্রতিবাদে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনও রোববার থেকে চার ঘণ্টার কর্মবিরতি (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত) পালন শুরু করেছিল। রোববার বিকালে বন্দর কর্তৃপক্ষ গাড়ি প্রবেশের বর্ধিত ফি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রাতে সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারীদের বর্ধিত প্রবেশ ফিও স্থগিত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার থেকে তাদের চার ঘণ্টার কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর থেকে বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী গাড়ির প্রবেশ ফি ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩০ টাকা করা হয়। এর প্রতিবাদে বড় ধরনের আন্দোলনে নামে প্রাইমমুভার ট্রেইলর মালিক-চালক সমিতিসহ পণ্যবাহী গাড়ির চালক-মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। শনি ও রোববার দুই দিনের ঘোষিত ও অঘোষিত কর্মবিরতিতে ভয়াবহ অচলাবস্থার মুখে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দর। গাড়ি প্রবেশ না করায় এবং পণ্য পরিবহণ বন্ধ করে দেওয়ায় বন্দরের অভ্যন্তরে যেমন কনটেইনারের জট সৃষ্টি হয় তেমনি রপ্তানি পণ্য না নিয়ে ৬টি বিদেশি জাহাজের বন্দর ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মালিক-চালকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে রোববার পরিস্থিতির সাময়িক সমাধান করে। বন্দরে পণ্যবাহী গাড়ি প্রবেশের বাড়তি মাশুল আপাতত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানানোর পর পরিবহণ শ্রমিকরা বন্দরের পণ্য পরিবহণে রাজি হয়। একই সঙ্গে স্থায়ীভাবে বর্ধিত মাশুল বাতিলের দাবি জানানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে তারা লিখিত চিঠিও চান।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘চেয়ারম্যানসহ বন্দরের সদস্যরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুধু যানবাহন খাতে যে ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে সেটা স্থগিত থাকবে। আমরা চবক বোর্ডে সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাব। যেহেতু ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে বন্দরের ডেলিভারি, আমদানি-রপ্তানি সরাসরি সংশ্লিষ্ট তাই সরকারি সিদ্ধান্তের জন্য যানবাহন খাতে বর্ধিত ট্যারিফ স্থগিতের সুপারিশ পাঠানো হবে।’
সূত্র জানায়, রোববার চবক চেয়ারম্যান সদস্যদের মতামত নিয়ে কেবল যানবাহন খাতে বর্ধিত ট্যারিফ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে সাময়িক সংকট নিরসন তথা পরিস্থিতি সামাল দেন। কিন্তু বন্দরের সেবা খাতে গত ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে কার্যকর হওয়া ৪১ শতাংশ বর্ধিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে সরকারের কাছে ১ সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। গত শনিবার চট্টগ্রামের একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সর্বস্তরের এক ব্যবসায়ী সমাবেশ থেকে ওই আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিও পাঠানো হয়। ওই সমাবেশ থেকে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে গেলে তার দায়দায়িত্ব সরকার তথা যারা বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর করেছে তাদেরই নিতে হবে।
এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো স্বাভাবিক রাখতে আমরা একটি আলটিমেটাম দিয়েছি। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি যেহেতু জুলাই সনদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, হয়তো এ কারণে এ বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আমার মনে হয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় নিশ্চয় এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন। বন্দরের সেবা খাতে বর্ধিত ৪১ শতাংশ ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করবেন। আমরা তার দিকে তাকিয়ে আছি। তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। আশা করছি চট্টগ্রামের সন্তান হিসাবে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে সৃষ্ট সংকট যা পুরো দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে; সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেবেন। ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবির বিষয়টি তিনি অনুধাবন করবেন।’
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন যুগান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর লোকসানে নেই। প্রতিবছর সব খরচ বাদ দিয়ে এমনিতেই আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। ট্যারিফ কার্যকর হলে এই মুনাফা দ্বিগুণ, তিনগুণ হবে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের গলায় ছুরি বসিয়ে এত মুনাফা করার কী প্রয়োজন আছে বন্দরের। তাছাড়া বন্দর তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। সেবা প্রতিষ্ঠান।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মতামত ছিল সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর। নৌপরিবহণ উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যবসায়ীরা তাদের এই মতামত তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এটা ব্যবসায়ীদের এক প্রকার অপমান করার শামিল।’
বন্দরের অর্ধশতাধিক সেবা খাতে যে বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর হয়েছে তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতে। প্রতি ২০ ফুট একক কনটেইনারের ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। যা আগে ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এতে প্রায় ৩৭ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আমদানি কনটেইনারে বাড়তি ৫ হাজার ৭২০ টাকা ও রপ্তানি কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা বাড়তি মাশুল দিতে হবে। এছাড়া প্রতিটি কনটেইনার জাহাজে উঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা বাড়তি খরচ যুক্ত হবে। কেবল কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতেই ২৫ থেকে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি পেয়েছে। কার্যকর হওয়া ট্যারিফ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপেই ধাক্কাটি আসে পণ্য পরিবহণ খাতে। পণ্যবাহী প্রতিটি গাড়িকে বন্দরে প্রবেশ করতে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সার পরিবর্তে এক লাফে ২৩০ টাকা দিতে হয়। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকরের কারণে কেবল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, এই টাকা তুলতে হবে ভোক্তাদের কাছ থেকে। বাড়তি ট্যারিফ বা মাশুলের খক্ষ বসবে দেশের ১৮ কোটি মানুষের ওপর।
যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার পরিবহণের ৯৯ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর পর সামঞ্জস্যপূর্ণ, টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এশিয়ার ১০টি ও ১৭টি আন্তর্জাতিক বন্দরের ট্যারিফ পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে।