সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য পদে গত ২ জানুয়ারি ছয়জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। পরে ১৩ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে দেশের কয়েকটি জেলায় ডিসি নিয়োগ দিয়ে পরে তা বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এভাবে নিয়োগ দিয়ে পরে তা বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। বিদেশে কূটনৈতিক মিশনের কর্ণধার থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়টির পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে বারবার।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তথ্যের ঘাটতি, বাছাই প্রক্রিয়ায় ত্রুটি এবং তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দেয়ার কারণেই বারবার নিয়োগ দিয়ে তা বাতিলের ঘটনা ঘটছে। আবার বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর আলোচনা বা অন্যান্যভাবে প্রভাবিত হয়ে নিয়োগ বাতিলের নজিরও রয়েছে।
নিয়োগ দেয়ার পর তা আবার দ্রুততার সঙ্গে বাতিলের কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিটি নিয়োগ মেরিট অনুযায়ী হওয়ার কথা। তবে নিয়োগে যদি কোনো ধরনের ত্রুটি হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সেটির সমাধান ও সংশোধন করতে হয়। সেজন্য মাঝেমধ্যে বাতিল করতে হয়। তবে সবগুলো বাতিল হয় এমন তো না। দু-একটা হতে পারে।’
পিএসসি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গত ২ জানুয়ারি ছয়জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। তারা হলেন অধ্যাপক শাহনাজ সরকার, মো. মুনির হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ, মো. মিজানুর রহমান, শাব্বির আহমদ চৌধুরী ও অধ্যাপক সৈয়দা শাহিনা সোবহান। ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শপথের দিন নির্ধারণ করা হয়। আবার পিএসসি থেকেই তাদের শপথ স্থগিত চেয়ে ৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে এক চিঠি পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ জানুয়ারি নতুন ছয় সদস্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। পরে ১৩ জানুয়ারি ওই ছয়জনের নিয়োগ বাতিল করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পিএসসিসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পিএসসিতে সদস্য পদে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা দেখা দেয়ায় তাদের শপথ স্থগিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর কূটনীতিক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগের ১০ দিন পর তার সে নিয়োগ বাতিল করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিসিএস ২০তম ব্যাচের (পররাষ্ট্র ক্যাডার) এ কর্মকর্তার নিয়োগ ১০ দিনের মাথায় বাতিলের কারণ সম্পর্কে জনকূটনীতি বিভাগ থেকে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কূটনীতিককে নিয়োগ দিয়ে তা এভাবে বাতিলের নজির ২০২১ সালের পর এটিই প্রথম। ওই বছর সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খন্দকারকে ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে এ নিয়োগ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়।
এ নিয়োগ বাতিল প্রসঙ্গে ৬ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক তৌফিক হাসান জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের উপ-হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরের পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করা হলো।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা সমাজে ইতিবাচক বার্তা দেয় না। ভিন্ন মতবাদ, গোষ্ঠী বা দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হচ্ছে। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা ও পূর্বপ্রস্তুতির জায়গা থেকেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য তাদের কাছে থাকছে না। সে কারণে নিয়োগ দিয়ে আবার তা বাতিলের ঘটনাও ঘটে চলেছে। তবে একবার নিয়োগ দিয়ে বাতিল করাটা ভালো বার্তা দেয় না। এজন্য বিতর্ক এড়াতে সরকারের উচিত সময় নিয়ে পর্যালোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটির একটি কারণ হতে পারে যে এখন কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী সরকার পরিচালনা করছে না। বেশকিছু মতবাদ, গোষ্ঠী বা দলের সমন্বয়ে বর্তমান সরকার পরিচালিত হচ্ছে। সরকার সম্ভবত সবাইকে তুষ্ট করা বা খুশি রাখতে চেষ্টা করছে। ফলে একটি পক্ষ যেটায় খুশি হচ্ছে, অন্য পক্ষ সেটায় খুশি নয়। ফলে যখনই সেখান থেকে কোনো প্রতিবাদ আসছে বা আপত্তি তোলা হচ্ছে, তখনই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে আমরা সেটিই দেখতে পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি দর্শন থাকে, আদর্শ থাকে। সে অনুযায়ী তারা কাজকর্ম করে। ফলে সেখানে এদিক-ওদিক করাটা কম হয়। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু নির্দিষ্ট দলের নয়; অনেক দল, মত ও পথের মানুষ মিলে সরকার পরিচালনা করছেন; তারা সবাই নিজেদের মতো করে দেখছেন। ফলে যে গোষ্ঠী, মতবাদ বা পথ শক্তিশালী হচ্ছে; তখন তাদেরটাই সরকার মেনে নিচ্ছে। এটি থেকে আসলে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। অনেকেই ভাবছেন যে আমি যদি একটা মব সৃষ্টি করতে পারি, কোনোভাবে কাউকে ঘেরাও বা অবরোধ করতে পারি তাহলে আমারটা শোনা হবে এবং সেটিই হয়েছে। গত পাঁচ-ছয় মাসে এমন বহু ঘটনা দেখা গেছে। এজন্য এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ একবার নিয়োগ দিয়ে বাতিল করাটা ভালো বার্তা দেয় না। মনে হচ্ছে এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই তড়িঘড়ি করা হচ্ছে, আবার বাতিলের ক্ষেত্রেও একই। তাই যেকোনো বিতর্ক এড়াতে সরকারের উচিত সময় নেয়া।’
চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিনিস্টার অ্যান্ড ডেপুটি চিফ অব মিশনের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একান্ত সচিব (পিএস) পদে গত ২২ অক্টোবর নিয়োগ দেয় সরকার। একদিনের মাথায় এ নিয়োগ বাতিল করা হয়।
এর আগে গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাট, রাজশাহী, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, শরীয়তপুর ও নাটোরে নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেয় সরকার। তার আগে দেড় মাসেরও বেশিদিন জেলা প্রশাসকশূন্য ছিল দেশের এ আটটি জেলা। পরে ১১ সেপ্টেম্বর ওই আট জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নিয়োগ আদেশ বাতিল করে সরকার।
একইভাবে ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেয়া হয়। তবে এ নিয়োগের ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই তাকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিয়োগ দিয়ে সেটা বাতিল করা নতুন কিছু না। আমার ধারণা নিয়োগদান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় হয়তো তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। নিয়োগের পরে কিছু তথ্য হয়তো চলে আসে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হাতে। এরপর তারা মনে করেন যে নিয়োগটা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে।’
তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি সরকার। যারা সরকার পরিচালনা করছেন তারা সবাই হয়তো অভিজ্ঞ। কিন্তু তাদের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। একটি সরকার যখন চলমান থাকে তাদের প্রস্তুতি থাকে। তারা খোঁজখবর নিতে পারেন। আবার যারা নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসেন, তাদেরও একটা প্রস্তুতি থাকে। নির্বাচনের আগ থেকেই খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন। যারা বর্তমানে সরকার পরিচালনায় রয়েছেন, তারা সবাইকে চেনেন না। সেটি সম্ভবও নয়। এক্ষেত্রে তাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ ধরনের ঘটনায় দেখা যায় হয়তো প্রথম সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সব তথ্য তাদের কাছে থাকে না। সে কারণেই পরে তারা সিদ্ধান্ত বদল করেন।’