
কয়লা আমদানি জটিলতায় থমকে আছে পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরীক্ষামূলকভাবে চালুর ৮ মাস অতিবাহিত হলেও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু না করায় রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে চার দফা দরপত্র ডেকেও বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। ভারতের আদানি গ্রুপের চড়া দামের বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে ‘লুণ্ঠন’ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নানান অজুহাতে বসিয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের।
চার দফায় দরপত্রে অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের সুযোগ না দেওয়ায় ‘সিন্ডিকেটের অনিয়ম’ তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইয়াংথাই এনার্জি। প্রধান উপদেষ্টার কাছে করা অভিযোগে বিগত সরকার থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই খাতের নানা অনিয়ম ও হয়রানির বিবরণ তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পটুয়াখালী জেলার পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অদূরে কলাপাড়া উপজেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করে। ৯৫০ একর আয়তন জায়গাজুড়ে আরএনপিএল নামের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের আগস্টে।
মোট নির্মাণ ব্যয়ের দুই দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এক দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ। ১৫ বছরমেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। চুক্তিতে প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী মাস থেকে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ নামের বোঝা বহন করতে হবে। তবে সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর ৮ মাস পার হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
কয়লা নেই, বাণিজ্যিক উৎপাদনও নেই
সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য গত জানুয়ারিতে প্রস্তুত হয়। প্রথমদিকে প্রতিদিন ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় এই কেন্দ্র থেকে। পর্যায়ক্রমে তা এখন ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে। কেন্দ্রটি থেকে প্রতি মাসে সাড়ে ১০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলার পর অন্তত সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের (জ্বালানি খরচ বাদে) বিদ্যুৎও উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ২০ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের বিদ্যুতের বার্ষিক চাহিদার ১০ শতাংশ মেটানোর জন্য এই কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। তবে প্রয়োজনীয় কয়লার জোগান না থাকায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না। একই কারণে এখনো এটির সিওডি সম্পন্ন হয়নি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা জানান, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফ্লাই অ্যাশ সাইলো, ফুয়েল-ওয়েল পাম্প, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, ফায়ার স্টেশন পরিষেবা এবং অগ্নিনির্বাপক পানির ট্যাঙ্ক, বয়লার, পাওয়ার হাউস, টারবাইন, জেনারেটর, চিমনি, বর্জ্য পানি সংরক্ষণাগার বেসিন, প্রশাসনিক ভবন, প্রকৌশল ভবন, মাল্টিপারপাস হল, ওয়ার্কশপসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ডরমিটরি, ক্যান্টিন ও মসজিদের পাশাপাশি আমদানি করা কয়লা খালাসের জন্য কনভেয়ার বেল্টসহ আধুনিক জেটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
কয়লা সরবরাহ নিয়ে জটিলতা
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর নির্ধারিত সময় পার হলেও কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। এতে চিহ্নিত পুরোনো সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ- সংশ্লিষ্টরা যেভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করে আসছিল, এখনো তারাই এ খাতটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে পটুয়াখালী আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘নসরুল হামিদ সিন্ডিকেট’-এর বাধায় কয়লা আমদানির জন্য চারবার দরপত্র ডেকেও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিল করায় এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দরপত্রে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের বিভিন্ন ধাপে ত্রুটি থাকায় চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। শিগগিরই নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকার পরও চালু না করায় আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে সরকারকে জরিমানা গুনতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ
বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্য দরপত্রে অংশ নিয়ে প্রথম হওয়ার পরও কার্যাদেশ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে ইয়াংথাই এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। গত ২১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগে ইয়াংথাই এনার্জি উল্লেখ করেছে, দরপত্রের সব শর্ত পূরণ করে তারা যোগ্য বিবেচিত হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর চাপের কারণে কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যাদেশ দিতে পারছে না। তারা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর আগেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে দফায় দফায় শর্ত শিথিল করা হয়েছিল। এরপরও সিন্ডিকেটের পছন্দের কোম্পানি না আসায় শর্ত শিথিলের কথা বলা হচ্ছে। যদিও সর্বশেষ মূল্যায়ন আর্থিক প্রতিবেদনে ইয়াংথাই এনার্জি প্রস্তাবিত দরকে সাশ্রয়ী বলে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল।
দরপত্র প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে কোম্পানিটিকে বঞ্চিত করা, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের অনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ক্ষতি, বিদেশি কোম্পানিকে হয়রানি ও বিদেশি বিনিয়োগে অনাস্থা তৈরির আশঙ্কাও জানানো হয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে করা অভিযোগে। এতে আরো বলা হয়, বিদ্যুৎ খাত-সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষ ব্যক্তি এবং আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন সাবেক কর্মকর্তা অনৈতিক প্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়। অবশ্য এসব ঘটনার প্রতিকার চাওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা সিঙ্গাপুরের এই প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের বিষয়ে আমার দেশকে জানান, ‘সর্বশেষ দরপত্রটি বাতিল করা হয়েছে সাশ্রয়ীভাবে কয়লা কেনার জন্য। এটি দেশের স্বার্থেই করা হয়েছে। কিছুটা কম দামে কয়লা কেনার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’
আদানির উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ আমদানি বহাল রাখতে কারসাজি
ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানি করে লুণ্ঠন ব্যবস্থা বহাল রাখতে পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিসহ দেশের প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো হয়নি বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। আমার দেশকে তিনি বলেন, শুধু পটুয়াখালীর ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু করলে আদানির কাছ থেকে আর বিদ্যুৎ এনে দেশের কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হতো না। এখানে সুবিধাভোগী শ্রেণির আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকায় তারা কোনোভাবেই দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে চায় না। আগের লুণ্ঠনকারী সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করত, এই সরকারও সেখান থেকে বের হতে পারেনি বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
অধ্যাপক শামসুল আলম আরো বলেন, এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করেছিলাম আগের সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে যে অলিগার্ক তৈরি করে গেছে, সেটা ভাঙা হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এক বছর পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই অলিগার্কের থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারনি। বরং তাদের দ্বারা সরকার ঘেরাও হয়ে গেছে। আগের সেই সুবিধাভোগী শ্রেণিই এ খাতের নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করতে পারলে ফার্নেস ওয়েলের মতো উচ্চ ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন হতো না। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কম হতো। সেই গ্যাস আমরা শিল্পে সরবরাহ করতে পারলে শিল্প-কারখানার মালিকরাও কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন। এখন সরকার অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ের দেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখছে। আবার ভারতের আদানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আসলে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকারকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন জ্বালানি খাতের এই বিশেষজ্ঞ।
কয়লা আমদানিতে প্রতিযোগিতা চায় সরকার
কয়লা জটিলতা তৈরি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে উৎপাদন শুরু না করার বিষয়ে জানতে আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. নাজমুস সায়াদাতের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। একাধিকবার তার ব্যক্তিগত ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে এ বিষয়ে ক্ষুদেবার্তা দিলেও তিনি জবাব দেননি।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আমার দেশকে বলেন, দরপত্রে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। আমরা চাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কয়লা আমদানির কাজটি দিতে, যাতে তুলনামূলক কম মূল্যে আমরা কয়লা আমদানি করে দেশের অর্থ সাশ্রয় করতে পারি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি। ফলে আমাদের অনেক কিছুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে।
উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘কয়লা আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা একটি উচ্চপর্যায়ের কারিগরি কমিটি করে দিয়েছি। শিগগিরই ওই কমিটি সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আশা করছি। সেখানে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি যদি বিবেচিত হয়, তারাও কাজ পেতে পারে। আমরা চাই সবকিছুই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হোক।’