Image description

নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৪৭ বছর পাড়ি দিল বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলেও বাকি সময় নানা সংকট মোকাবিলা করেছে দলটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সুসময়েও এখন ভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, ভোট বানচালের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা এবং নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে একক প্রার্থী ঠিক করা দলটির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব ক্ষেত্রে সফল না হলে সমস্যার মুখে পড়তে পারে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি।

বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের অভিমত-অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ৪৭ বছর পার করেছে দলটি। এখন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরেছে। দীর্ঘ ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে। এ সময়ে হামলা-মামলা, গুম-খুন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু নেতাকর্মী-সমর্থক। দল ভাঙারও চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার। নেতাকর্মীদের দৃঢ় মনোবল এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থা থাকায় কোনো কিছুই সফল হয়নি। ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে দেশি-বিদেশিদের আস্থা অর্জনে তারা সক্ষম হয়েছে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ ও দৃশ্যমান বিচার চান। একই সঙ্গে তারা দলকে সুসংগঠিত করে নতুন সব চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করবেন। আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিপুল সমর্থন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলেও প্রত্যাশা তাদের।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ১ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দিনটি এবার বড় পরিসরে উদ্যাপন করছে দলটি। নিয়েছে সাত দিনের কর্মসূচি। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে বলেন, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে এর চর্চা, বিকাশসহ দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য বিএনপি আজ সমধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাসহ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, এখনো প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইনের শাসন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এজন্য জনগণের নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক সরকার অতীব জরুরি। দেড় যুগব্যাপী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান সার্থক হবে, যদি আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফা রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। সামনে নির্বাচনে জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই এবং মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে হবে। জনগণের রায়ে ক্ষমতায় গেলে কী পরিকল্পনা, তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দলটি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ এখনকার বিএনপি কতটা অনুসরণ করছে বা করছে না, সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হলে আগে দেখতে হবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর কী হয়। তখনকার বাস্তব কার্যক্রমের ভিত্তিতে মন্তব্য করা সহজ হবে তারা কতটা জিয়াউর রহমানের আদর্শ অনুসরণ করছে বা করছে না।

তিনি আরও বলেন, সামনের দিনে বিএনপির চ্যালেঞ্জ আছে। যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তারা পায়, নিশ্চিত করতে হবে ঘুস-দুর্নীতি এসব জিনিস যাতে আর না ঘটে। তাদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিকভাবে যারা প্রকৃত বন্ধু, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন। যেসব রাষ্ট্র বা যে রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি বৈরিতা প্রদর্শন করে, তাদের এই বৈরিতাকে মোকাবিলা করা।

১৯৭৮ সালের এই দিনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসে দলটির হাল ধরেন। পরিচিতি পান আপসহীন নেত্রী হিসাবে। তার নেতৃত্বে তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয় বিএনপি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে পারেনি দলটি। দ্বাদশ সংসদের একতরফা নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে বদলে যায় দৃশ্যপট, যা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পটভূমি বলে দাবি দলটির। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় দলের কারাবন্দি সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে, যা নিয়েও বিব্রত পরিস্থিতির মুখে দলটি। যদিও বিএনপি হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান নিয়ে অনেককে বহিষ্কার করেছেন। অপকর্মের বিরুদ্ধে দলটি জিরো টলারেন্স নীতিতে। তবে বিএনপির বিরুদ্ধে এ নিয়ে একধরনের অপপ্রচার চলছে বলেও মনে করেন নেতারা। এ অপপ্রচার মোকাবিলা করতেও তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলেও রাজনীতিতে নেই তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে তার ছেলে তারেক রহমান বিদেশে থেকে দল পরিচালনা করছেন। তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে দল পরিচালনা করছেন।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমবার সংকটে পড়েছিল বিএনপি। আশির দশকে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর দ্বিতীয়বার গভীর সংকটে পড়ে দলটি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়াসহ বিপুলসংখ্যক শীর্ষ নেতা কারাবন্দি হলে দলটি তৃতীয় দফা নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। তিনবারই ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলেও নানাভাবে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এভাবে নানা সংকট ও ভাঙা-গড়ার মধ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখন জনগণের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে বিএনপি।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সময়ের প্রয়োজনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চার পথ খুলে দেন তিনি। পরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর বিএনপি কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছেন। এমনকি লাখ লাখ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে। অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দল পরিচালনা করছেন।

তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। মানুষ এই নির্বাচনে ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিএনপি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জনগণ বিএনপির পাশে থাকবে বলে আমরা আশাবাদী।

কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষ্যে সাত দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। রোববার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভা হয়। আজ সকাল ৬টায় বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বেলা ১১টায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফাতেহা পাঠ করা হবে। জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এদিন দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র‌্যালি হবে। মঙ্গলবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হবে। ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা ও পৌরসভায় আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র‌্যালি হবে। এছাড়া সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে বিএনপির উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক করা হবে। সুবিধাজনক সময়ে ঢাকাসহ দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ অভিযান, মৎস্য অবমুক্তকরণ, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ক্রীড়ানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।