Image description
সংক্ষিপ্ত হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শেখ হাসিনার নামের আগে বসবে ‘স্বৈরাচারী শাসক’ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে যুক্ত হচ্ছে রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনের তথ্য

আগামী বছরের পাঠ্যবইয়েও আসছে একগুচ্ছ পরিবর্তন। বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। শেখ হাসিনার নামের আগে বসছে ‘স্বৈরাচারী শাসক’। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ে যুক্ত হচ্ছে রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনের তথ্য।

বিশেষ করে অষ্টম, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, পৌরনীতি ও সুশাসনসহ বেশ কিছু বইয়ে বড় সংযোজন বা বিয়োজন হচ্ছে।

এ ছাড়া অন্য প্রায় সব শ্রেণির বইয়ের কনটেন্টে ছোটখাটো পরিবর্তন হচ্ছে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে।  

গত সোমবার এনসিটিবিতে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক অনুমোদনসংক্রান্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম কমিটির (এনসিসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় অংশ নেওয়া জাতীয় শিক্ষাক্রম কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন পুস্তক পর্যালোচনায় জড়িত শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন পাঠ্যবই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

তবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাঁরা ভাষণ রেখে সংক্ষিপ্ত করার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে সভায় কিছুটা বাগবিতণ্ডাও হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভাষণ সংক্ষিপ্ত করার ব্যাপারে বেশির ভাগ সদস্যই একমত হন।
 
মাধ্যমিকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ রয়েছে।

এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। সেখানে এনসিটিবির কর্মকর্তা ছাড়াও বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি রয়েছেন। ওই কমিটি যেভাবে মত দেয়, সেভাবেই আমরা ভাষণটি রাখব। মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ের কনটেন্টে কিছু পরিবর্তন আসছে।

এ ছাড়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ে প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে বলা হয়েছে।’

সূত্র জানায়, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্যে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাথা’ গদ্যটি সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবকারী মনে করছেন, গদ্যটিতে সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম কৌশলে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অপরাধী ও অনুঘটকদের নাম ও কার্যকলাপ চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। গদ্যে ব্যবহৃত কিছু শব্দ পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন প্রস্তাবকারী; যেমন—‘শাসক’, ‘দুর্বৃত্তবাহিনী’, ‘তার আছে দলীয় বাহিনী’ এবং ‘আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে যথাক্রমে ‘স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা’, ‘আওয়ামী লীগ’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী’ ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অষ্টম শ্রেণির বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়াও হুমায়ুন আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো লেখকদের লেখা পর্যালোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য অংশের ‘রহমানের মা’ গল্পটি পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘রহমানের মা’ বাংলাদেশের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কনটেন্ট দেওয়া যাবে না। গল্পটি স্পর্শকাতর। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও ধর্মবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর পরিবর্তে এসংক্রান্ত অন্য গল্প যুক্ত করা যেতে পারে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ নাটকের চেয়ে সাবলীল শুদ্ধ ও রুচিশীল এবং ভাষাতাত্ত্বিক অনেক ভালো নাটক আছে বলে প্রস্তাব করেন কেউ কেউ। অশ্রাব্য ও কটু ভাষা-বাক্যের জন্য এটি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নাটকটির সংলাপে বেশ কিছু গালি ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অস্বস্তি তৈরি করবে বলে সভায় প্রস্তাব আসে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী অনেক ইতিহাসই পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। একক ব্যক্তি বন্দনা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যেন একক কোনো ব্যক্তি, নির্দিষ্ট একটি পরিবার কিংবা বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের একক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ে পরিবর্তন আনা হলেও উচ্চ মাধ্যমিকে এখনো হয়নি।

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস, পৌরনীতি ও বাংলা বইয়ে এখনো বিতর্কিক বিষয়বস্তু যুক্ত রয়েছে। তবে আগামী বছরের বইয়ে যে দল বা যে নেতার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য তাঁকে ঠিক ততটুকুই সম্মান দেওয়া হবে। অতিবন্দনার কোনো সুযোগ এখানে রাখা হবে না বলে এনসিসির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গল্প নিয়ে একটি অধ্যায় যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পৌরনীতি ও সুশাসন বইয়ে আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচনের প্রকৃত তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর রাতের ভোট ও ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা হবে। এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ) রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ও অবদানকে যৌক্তিকরূপে উপস্থাপন এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি সংযোজন করা হবে। তৃতীয় অধ্যায়ে (রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ) শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিষয়ে কনটেন্ট যুক্তকরণ এবং সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনার পরিসরে সমতা বিধান করতে বলা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে (বাংলাদেশের সংবিধান) পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে বাস্তবানুগ আলোচনা সংযোজন করা এবং অষ্টম অধ্যায়ে (বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা) ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে বলা হয়েছে।