Image description
সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় আসছে বড় পরিবর্তন খাতের দুই সচিব পদে সুযোগ বাড়ল রাজস্ব কর্মকর্তাদের অনুমোদনের জন্য শিগগিরই উঠছে উপদেষ্টা পরিষদে

শেষ পর্যন্ত রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব এ খাতের কর্মকর্তাদের হাতেই যাচ্ছে। অনেক আন্দোলন, সমালোচনা ও বিতর্কের পর সরকার অধ্যাদেশ সংশোধন করে এই খাতের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবে। অন্য পদগুলোতেও প্রশাসন ক্যাডারের একক নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। অধ্যাদেশের সংশোধিত খসড়ার প্রস্তাবে বলা হয়, রাজস্বনীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের শীর্ষ দুই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, পরিকল্পনা, রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা হওয়া বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া অধ্যাদেশের অন্তত ১১টি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন-বিয়োজনের প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। সবকিছু ঠিক থাকলে অনুমোদনের জন্য আগামী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এটি উপস্থাপন করা হতে পারে। সচিবালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র আরো জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামের দুটি বিভাগ করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

নতুন অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন একটি বিভাগ করবে এবং আদায় করবে আরেক বিভাগ। দুই বিভাগে সরকার চাইলে উপযুক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকেই সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া যায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিব হতে যেকোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে এই দুই বিভাগেও সচিব করা যাবে।

অধ্যাদেশ জারির পর আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের আশঙ্কা তৈরি হয় যে নবগঠিত দুই বিভাগের শীর্ষ পদে তাঁদের বদলে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারাই নিয়োগ পাবেন।

মূলত এ নিয়েই কয়েক মাস ধরে কমপ্লিট শাটডাউনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দীর্ঘ সময়ের এই আন্দোলনে প্রায় অচল হয়ে পড়ে রাজস্ব খাত। সাধারণ মানুষ ও করদাতারা এ সংস্থার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অধ্যাদেশ সংশোধন এবং তাঁদের আন্দোলন বন্ধের অনুরোধ করলেও তাঁরা শোনেননি। অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এনবিআরের আন্দোলন প্রায় ব্যর্থ হয়ে যায়।
 
সবাইকে কাজে ফিরে যেতে হয়। এ ঘটনার পর অনেক কর্মকর্তা তদন্তের মুখে পড়েন। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের ৯ জনসহ মোট ৩৬ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কাউকে কাউকে বদলি করা হয়।

এনবিআরের ভেতরে যখন এসব কর্মকাণ্ড চলমান, তখনই জানা যায় যে অধ্যাদেশ সংশোধন করে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি অনুযায়ী শীর্ষ দুই পদে যাঁদের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে তাঁরা আর্থিক, বাণিজ্য ও রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারাই হবেন।

যেসব গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধন করা হচ্ছে : রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের বিষয়ে খসড়ায় ধারা ৪(৩)-এর পরিবর্তে প্রস্তাব করা হয়েছে সরকার সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, পরিকল্পনা, রাজস্বনীতি বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করিবে। বর্তমানে আছে, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ করিবে।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব নিয়োগের বিষয়ে ধারা ৭(৩)-এ প্রস্তাব করা হয়েছে, সরকার রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে এরূপ যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব নিয়োগ করিবে। বিদ্যমান অধ্যাদেশে এ বিষয়ে বলা আছে, সরকার রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে এরূপ যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করিবে।

রাজস্বনীতি বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগের নিয়োগের বিষয়ে আরো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবের ৪(৪) ধারায়। এতে বলা হয়েছে, রাজস্বনীতি বিভাগের আয়করনীতি, দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মতামত, শুল্কনীতি, মূল্য সংযোজন কর নীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমস সংক্রান্ত চুক্তি অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে পূরণযোগ্য হইবে।

উপধারা (৪) এর পর নতুন উপধারা (৪ক) সংযোজন করে বলা হয়েছে, রাজস্বনীতি বিভাগের অন্য অনুবিভাগসমূহের পদসমূহ জনপ্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, হিসাব ও নিরীক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা বা ব্যক্তিবর্গ হইতে পূরণযোগ্য হইবে।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ের খসড়ায় ধারা ৭(৪)-এ বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মাঠ পর্যায়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে পূরণযোগ্য হইবে। তবে বর্তমানে বিসিএস শুল্ক ও আবগারি ও কর ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। এতে বলা আছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মাঠ পর্যায়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগসমূহের বিভিন্ন পদে বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) এবং কর ক্যাডারে কর্মরত জনবলের মধ্য হতে নিয়োগ করা হইবে।

খসড়ার ধারা ৭(৫)-এ কিছুটা শিথিল করে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদসমূহ রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে পূরণযোগ্য হইবে। বর্তমানে তিনটি ক্যাডারকে সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ বিসিএস (প্রশাসন), বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে কর্মরত কর্মচারীগণ হইতে পূরণযোগ্য হইবে।

উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রতিবেদকের পরিচয় জানিয়ে এসএমএস করলেও তাতে তিনি সাড়া দেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, সংশোধন প্রস্তাবের সবচেয়ে বড় দিক হলো এনবিআরের দুটি বিভাগেই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না। যেহেতু নিয়োগের ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতি, বানিজ্যনীতি, পরিকল্পনা, রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এনবিআরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দিতে হবে।

গত ১৩ জুলাই অধ্যাদেশ সংশোধনের ইঙ্গিত দেন এনবিআরসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব নিয়োগের নীতিমালা করতে হবে; যাতে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমটা আরো বেগবান হয়। অধ্যাদেশের কয়েকটি সমস্যা আমরা চিহ্নিত করেছি। যেসব ত্রুটি পেয়েছি সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যেহেতু পরামর্শক কমিটি, সেহেতু এগুলো সমাধানের পরামর্শ দেব।