Image description
ইউক্রেন সংকট

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে সোমবার হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত শুক্রবার আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসা প্রস্তাব নিয়ে এ বৈঠক হয়। এতে কিয়েভের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার আশ্বাস দেন ট্রাম্প। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা ওভাল অফিস ও হোয়াইট হাউসে কয়েক ধাপের এ বৈঠককে ‘অগ্রগতিমূলক’ বলছে সব পক্ষ। আগে থেকেই জেলেনস্কি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের কথা বলে আসছিলেন। আলোচনার একপর্যায়ে পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠক আয়োজন শুরু করার কথা জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুতিনও এ আলোচনায় প্রস্তুত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আসন্ন ত্রিপক্ষীয় এ বৈঠকে কি প্রায় চার বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে? তবে বিশ্লেষকদের ভাষ্য, মস্কো ও কিয়েভ নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় না দিলে সংঘাত অবসানের সম্ভাবনা কম।

রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলছে, জেলেনস্কিসহ ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর সবাইকে আরেকটি বৈঠকের অপেক্ষায় রাখলেন ট্রাম্প। সে আরেকটি বৈঠকে তিনি বসতে চান পুতিন আর জেলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে। তবে সেই বৈঠক কবে হবে, কোথায় হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস আভাস দিয়েছেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, এ বৈঠক সুইজারল্যান্ডে হতে পারে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের অবসান ঘটাতে শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনকে নিয়ে বৈঠকে বসেন ট্রাম্প। সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বৈঠক চললেও প্রায় চার বছরের যুদ্ধ নিয়ে সেদিন কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি দুই নেতা। ওই বৈঠকের পরই জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। তার সেই আমন্ত্রণেই সোমবার ওয়াশিংটনে পা পড়ে জেলেনস্কির। সঙ্গে ছিলেন ইউরোপের বেশ কয়েকজন নেতাও।

সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওভাল অফিস ও হোয়াইট হাউসে বৈঠক চলে ট্রাম্প ও ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে। এসব বৈঠকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিই বারবার সামনে আনেন ইউরোপের নেতারা। বৈঠক যখন শেষের পথে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পুতিন ও জেলেনস্কির সম্ভাব্য বৈঠকের কথা জানান ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে একটি বৈঠক আয়োজনের কাজ তিনি শুরু করে দিয়েছেন।

ট্রাম্প জানান, এদিন জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাঝপথে তিনি পুতিনকে ফোন করে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন শুরু হলেও এরই মধ্যে জেলেনস্কিকে দুটি বিষয় মাথা থেকে বাদ দিতে বলেছেন ট্রাম্প। সোমবার হোয়াইট হাউসে বৈঠক শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি বলেন, ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইউক্রেন আর ফিরে পাবে না। ন্যাটোর সদস্য হওয়ার চিন্তাও বাদ দিতে হবে জেলেনস্কিকে। এতকিছুর পরও অবশ্য সোমবারের বৈঠককে ‘গঠনমূলক’ বলেন জেলেনস্কি। পুতিনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের ব্যাপারে প্রস্তুত থাকার কথাও বলেন তিনি।

বৈঠক শেষে হোয়াইট হাউসের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জেলেনস্কি বলেন, পুতিনের সঙ্গে ‘যত দ্রুত সম্ভব’ বৈঠকে বসার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন নেই, আমাদের প্রয়োজন সত্যিকারের শান্তি।’ জেলেনস্কি বলেন, “পুতিনের সঙ্গে যে কোনো ‘ফরম্যাটে’ আলোচনার জন্য ইউক্রেন প্রস্তুত আছে।”

এদিন ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানাতে হোয়াইট হাউসে হাজির ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লায়েন ও ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে।

মঙ্গলবার জেলেনস্কি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের অংশীদাররা নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়টি প্রকাশ করবেন এবং ধীরে ধীরে বিস্তারিত জানানো হবে। সবকিছু আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নথিবদ্ধ করা হবে।’

তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, পুতিন ট্রাম্পকে বলেছেন যে, তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে প্রস্তুত। চার বছরের যুদ্ধের পর পুতিন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত—এটি আসলে ‘বড় ব্যাপার’। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এলে এবং রাশিয়া, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈঠক হলে সেটা হবে ‘ঐতিহাসিক অগ্রগতি’।

বিশ্লেষকদের মতে, সোমবারের বৈঠক থেকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য টাইমসের প্রতিবেদনের আলোকে প্রথমটি আগেই বলা হয়েছে—পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠকের সম্ভাবনা। দ্বিতীয়টি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্ররা বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সামরিক নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষ ট্রাম্প তাতে সাড়া দিয়েছেন। তৃতীয়টি—যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের মতপার্থক্য। চতুর্থটি জেলেনস্কির কূটনৈতিক কৌশল। গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ব্যর্থ বৈঠকের পর এবার জেলেনস্কি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। প্রতিটি বক্তব্যে তিনি ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান, যা আমেরিকান নেতার কাছে ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। এ ছাড়া এবার তিনি পোশাকেও শালীনতা বজায় রেখেছিলেন, ফলে আগেরবারের মতো বিদ্রূপের শিকার হতে হয়নি। এবার তার পোশাকের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্পও। জেলেনস্কি এবার তার স্ত্রী ওলেনার পক্ষ থেকে ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের জন্য একটি চিঠিও উপহার দেন। এটি বৈঠকের পরিবেশকে আরও অনুকূল করে।

পঞ্চম বার্তাটি হলো, বৈঠকের প্রতিটি মুহূর্তে পুতিনের প্রভাব অনুভূত হয়েছে। ট্রাম্প বৈঠক চলাকালেই ফোনে পুতিনকে আলোচনার অগ্রগতি জানান। এমনকি তিনি মাখোঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমার মনে হয়, পুতিন একটি সমঝোতা করতে চান।’ তবে ইউরোপীয় নেতারা এ বিষয়ে সংশয়ী ছিলেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হোয়াইট হাউস সম্মেলনে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি, তবে এটি নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠক যদি সত্যিই অনুষ্ঠিত হয়, তবে যুদ্ধ সমাপ্তির পথে এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের শীর্ষ নেতারা ছাড় দিলে যুদ্ধ বন্ধে সমঝোতা সম্ভব। তবে পুতিনের প্রতি আস্থা রাখা নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের শঙ্কা রয়েই গেছে।