
এক ভাই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। আরেক ভাই অর্থ লুটেরা ব্যবসায়ী। লুটের অর্থের ছিটেফোঁটা দেন সে ক্ষমতাসীনদের। বাকি টাকা পাচার করেন বিদেশে। ব্যবসায়ী ভাইয়ের লুটের টাকায় রাজনীতি করেন আরেক ভাই। এলাকায় জনপ্রিয়তা নেই। কিন্তু তাতে কী, লুটের টাকার হিস্সা দিয়ে পান এমপির টিকিট। মন্ত্রিত্বও কিনে নেন অনায়াশে। লুটেরা ভাইকে লুটের সুযোগ করে দেন ক্ষমতা আর প্রভাব খাটিয়ে। এই হলো আওয়ামী স্বৈরশাসনের সময় ভাইবেরাদারের লুণ্ঠন কাহিনি। এই দুই ভাই হলেন- আজিজ খান আর ফারুক খান। আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন আমলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের শীর্ষে এই ভাইবেরাদার কোম্পানির সামিট গ্রুপ। আওয়ামী লীগের পতনের পর গত বছরের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন ফারুক খান। আর তার লুটেরা ভাই আজিজ খান, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন, গ্রহণ করেছেন সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থেকে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন লুটের লাইন্সেস। গত ১৫ বছরে এই ক্ষমতার ঢাল ব্যবহার করে এই পরিবার জনগণের টাকা লুট করে তরতর করে ওপরে উঠেছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ, সরকারি কেনাকাটা, পণ্য ও সেবার সরবরাহ করে সবাইকে পেছনে ফেলে ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছেন। বেসরকারি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের মালিক মুহাম্মদ আজিজ খানের পরিচিতি এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী হিসেবে।
সিঙ্গাপুরে তার নাম উঠেছে দেশটির শীর্ষ ৪১তম ধনীর তালিকায়। বিলিয়নেয়ার আজিজ খান প্রায় পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্য সূত্র ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই গ্রুপটির পরিচিতি দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অঘোষিত ‘হর্তাকর্তা’ হিসেবে। তাদের হাতে দেশের বিদ্যুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
এলএনজির নিয়ন্ত্রণও এই গ্রুপের হাতে। তথ্য-প্রযুক্তি, টেলিকম খাতের বড় স্টেকহোল্ডার সামিট গ্রুপ। এগুলোর বাইরেও সরকারের বড় বড় কেনাকাটায় আধিপত্য ছিল এই গ্রুপটির। এর মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়েছেন সামিট গ্রুপ। বদলে গেছে আজিজ খান, ফারুক খানের জীবন।
বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্য মতে, আজিজ খান ১.১২ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনী। অথচ এই টাকা তিনি বাংলাদেশ থেকে কোনো বৈধ উপায়ে নিয়েছেন বলে কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই। বরং এ পর্যন্ত দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠানের ২৪টি ভেঞ্চারকে সর্বসাকুল্যে ৬৯.৫ মিলিয়ন বা প্রায় ৭ কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৫.৪৫ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৪ কোটি ডলার বৈধভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর বাইরে আর কাউকে এর চেয়ে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আজিজ খানের বা সামিট গ্রুপের নাম নেই। অর্থাৎ আজিজ খান বাংলাদেশ থেকে যত অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছেন তার পুরোটাই অবৈধ। আইনের ভাষায় যাকে ‘অর্থ পাচার’ বলা হয়।
আজিজ খান শুধু যে সিঙ্গাপুরেরই শীর্ষ ধনী নন; যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের ২০২৪ সালে প্রকাশিত নিরীক্ষা ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকাতেও আছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। সাময়িকীটির করা ৭৮টি দেশের ২ হাজার ৭৮১ জনের তালিকায় ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে রয়েছেন আজিজ খান। যার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১.১২ বিলিয়ন ডলার। আয়ের খাত হিসেবে জ্বালানি খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, ৬৮ বছর বয়সি আজিজ খান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হয়েও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে সামিট গ্রুপের আজিজ খানের নাম শীর্ষে উঠে আসে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু ক্ষমতা যাদের হাতের মুঠোয় তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে তদন্ত করবে দুদক।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান দীর্ঘদিন ধরেই স্থায়ী নিবাসী (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করে আসছেন। তবে তার নাগরিকত্ব ছিল বাংলাদেশের। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশটির আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য আজিজ খানকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে।
সাত বছর ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের করা এ তালিকায় তিনি প্রথম জায়গা করে নেন ২০১৮ সালে। ২০২২ সাল থেকে তিনি ফোর্বসের বৈশ্বিক বিলিয়নেয়ার তালিকায়ও রয়েছেন। এত দিন পর্যন্ত এ তালিকায় তার নাম এসেছে একমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে। পাশাপাশি তাকে উল্লেখ করা হয়েছে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী নিবাসী হিসেবে।
গত বছর সিএনএ লাক্সারিতে মুহাম্মদ আজিজ খানের ব্যক্তিগত চিত্র সংগ্রহশালা ও শিল্পপ্রেম নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে ব্যবসায়িক কারণে তার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ ও দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাসের বিষয়টি উঠে আসে। এতে বলা হয়, আজিজ খান সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা ১৯৮৮ সাল থেকে। ২০১৬ সালে তিনি দেশটিতে তার কোম্পানি সামিটের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ফোর্বস সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর ২০২৪ সালের বার্ষিক তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ধনীদের সম্পদ ও অন্যান্য তথ্যও হালনাগাদ করা থাকে। ফোর্বসের হিসাবে গতকাল পর্যন্ত আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ডলার। তাকে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হলেও সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন আজিজ খান, তার স্ত্রী ও সন্তানরা দীর্ঘদিন ধরেই সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে তারা বাংলাদেশে এলেও বছরের বেশির ভাগ সময় সিঙ্গাপুরেই থাকেন। তার ভাতিজাও দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন।
আজিজ খান প্রথমবারের মতো ফোর্বসের সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন ২০১৮ সালে। সে বছর তিনি ছিলেন ৩৪ নম্বরে এবং তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে তার সম্পদ কমে ৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তবে ২০২০ সালে সম্পদ বেড়ে ৯৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়। ২০২১ সালে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ডলার। পরের বছরই তা ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয় এবং তিনি দেশটির ৪২তম শীর্ষ ধনীর তালিকায় ছিলেন। ২০২৩ সালে আজিজ খানের মোট সম্পদ দাঁড়ায় ১১২ কোটি ডলারে এবং শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে ছিলেন।
২০২২ সাল থেকে তার সম্পদ শতকোটি ডলার স্পর্শ করার পর থেকেই তিনি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকার পাশাপাশি ফোর্বসের বৈশ্বিক ধনীদের তালিকায় জায়গা করে নেন। ফোর্বসের হিসাবে, বর্তমানে তিনি বিশ্বের বিলিয়নেয়ার তালিকায় ২ হাজার ৬৭৪তম অবস্থানে রয়েছেন।
১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া মুহাম্মদ আজিজ খানের উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয় মাত্র ১৮ বছর বয়সে। বাবার কাছ থেকে নেওয়া ৩০ হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকায় জুতা তৈরির মাধ্যমে তার ব্যবসায় হাতেখড়ি। এসব জুতার একটি অংশ বাটা কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন তিনি। জুতা তৈরির পাশাপাশি পিভিসি (পলি ভিনাইল ক্লোরাইড) আমদানি শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি চিটাগুড়ের রপ্তানি ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেন। দেশের হয়ে তিনিই প্রথম চিটাগুড় রপ্তানি করেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় আজিজ খানের ভাগ্য। চিটাগুড় ব্যবসায়ী থেকে হয়ে যান বিলিয়নিয়ার, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী। এ যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর বিদ্যুৎ খাতকে বেসরকারি খাতে নেওয়ার মূল ষড়যন্ত্রকারী হলো আজিজ খান।
তার অলৌলিক উত্থান সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বিদ্যুতের ব্যবসা। এ ব্যবসার হাত ধরেই গত এক দশকে সম্পদে বড় উল্লম্ফনের দেখা পেয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান।
বর্তমানে আজিজ খানের সম্পদের বড় একটি অংশে অবদান রাখছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেড। কোম্পানিটির গত ২০ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০০৮ হিসাব বছর পর্যন্ত কোম্পানিটির সম্পদ ও নিট মুনাফায় যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সে তুলনায় এর পরের হিসাব বছরগুলোয় প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরও বেশি। ২০০৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির সম্পদ ছিল ১০০ কোটি ৮২ লাখ এবং নিট মুনাফা হয় ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
সর্বশেষ ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ১১ হাজার ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং নিট মুনাফা ১৭১ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার এই বিত্তের উৎস বৈধভাবে উপার্জিত নয়। বরং আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে লুটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তার সবচেয়ে বড় সুবিধা ভোগীদের একজন এই সামিট গ্রুপ।