বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আবারও বড় ধরনের সংস্কারের দ্বারপ্রান্তে। দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতার দুষ্ট চক্রে আটকে থাকা পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যয় হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে সরকারের কাছ থেকে চাওয়া হবে। বাকি অর্থ সংগ্রহ করা হবে আমানত বিমা ট্রাস্ট তহবিল এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে।
এটি শুধু বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। কেননা, এত বড় পরিসরে ব্যাংক একীভূত করার উদাহরণ এ অঞ্চলে বিরল।
কোন ব্যাংকগুলো একীভূত হচ্ছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় পাঁচটি ব্যাংককে একত্রিত করে নতুন একটি সরকারি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো—এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
বিদেশি বিনিয়োগ থাকার কারণে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এই তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। এটির জন্য আলাদা সমাধান খোঁজা হচ্ছে।
কেন দরকার হলো একীভূতকরণ?
দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্রমাগত অবনতি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায়। এদের মূলধন ঘাটতি বিপুল অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা, যা পরবর্তী সময়ে আরও বেড়েছে।
অপরদিকে, খেলাপি ঋণ এখন প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা—যা মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটির খেলাপি ৯৬ শতাংশ, গ্লোবালের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের প্রায় অর্ধেক ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এই ভয়াবহ খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের আস্থা ভেঙে পড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেখানে পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা, ২০২৫ সালের মে মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে ঋণস্থিতি ক্রমেই বেড়ে মে মাসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আমানত কমছে, ঋণ বাড়ছে—এই বৈপরীত্যে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
কোথা থেকে আসবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক পরিকল্পনায় অর্থায়নের কয়েকটি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে:
সরকারের মূলধন বিনিয়োগ: সরকারের কাছ থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে নেওয়া হবে।
আমানত বিমা ট্রাস্ট তহবিল: এ তহবিল থেকে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে এ তহবিলে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। তবে এ জন্য আইন সংশোধন জরুরি, কারণ বর্তমানে এ তহবিল কেবল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করা যায়।
আন্তর্জাতিক সহায়তা: বিশ্বব্যাংক ও এডিবি মিলিয়ে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে আইএমএফের কাছেও তহবিল চাওয়া হতে পারে।
জাতীয় বাজেট: চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে—যা এই উদ্যোগে কাজে লাগানো হবে।
নতুন ব্যাংকের কাঠামো
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকটি একেবারেই নতুন নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারের সম্মতি পাওয়ার পর পাঁচ ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করা হবে এবং সরকারের পক্ষে একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ করা হবে।
প্রথমদিকে ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে। কার্যক্রম শুরু হবে মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবন থেকে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। তবে একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকায় কিছু কর্মী পুনর্বিন্যাস হতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় নতুন শাখা খোলার মাধ্যমে কর্মীদের ধরে রাখা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, নতুন ব্যাংকটির জন্য ইসলামী ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক খাত ও আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে অভিজ্ঞ একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
সরকারের অর্থ ফেরত আসবে কীভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, “সরকার মূলধন ইক্যুইটি বা ঋণ যেভাবেই দিক না কেন, তা সুদসহ ফেরত নেওয়া হবে। সরকার কোনও লোকসান গুনবে না।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকটি প্রথমে তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি মালিকানায় চলবে। এরপর ধাপে ধাপে বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক কোনও বহুজাতিক সংস্থা নতুন ব্যাংকের মালিক হতে পারবে। তখন মুনাফাসহ সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
বিশেষ ছাড় ও নীতি সহায়তা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য নতুন ব্যাংকটি কিছু বিশেষ সুবিধা পাবে। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে বর্তমানে আমানতের ৪ শতাংশ নগদ জমা (সিআরআর) এবং সাড়ে ৫ শতাংশ তারল্য (এসএলআর) রাখতে হয়। নতুন ব্যাংককে শুরুতে এ নিয়ম থেকে ছাড় দেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাঁচটি দুর্বল ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গঠিত এই নতুন ব্যাংক কি প্রকৃত অর্থে টেকসই সমাধান দিতে পারবে, নাকি কেবল সময়ক্ষেপণের আরেকটি প্রক্রিয়াই প্রমাণিত হবে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংস্কার কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এগুলোতে বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি হয়েছে। একীভূত করার এই উদ্যোগ সফল হলে বিশ্বের সামনে নতুন নজির স্থাপন করা সম্ভব। তবে নতুন ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হলে দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ ও যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।” তিনি আরও বলেন, ‘‘নতুন ব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা টেকসই না হলে এই বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প ব্যর্থ হতে পারে।’’
আস্থা ফেরানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
সব মিলিয়ে একীভূত হওয়ার পর ব্যাংকটির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকের সঞ্চিতিতে ধস নেমেছে, ঋণ শোধ হচ্ছে না, আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অবিশ্বাস্য মাত্রায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমানতকারীদের নিরাপত্তাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য নতুন ব্যাংককে নানাভাবে সহায়তা করা হবে।”