
অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের হাতেনাতে ধরার একটি কার্যকর কৌশল হচ্ছে ‘ফাঁদ মামলা’। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তবে গত এক বছরে ফাঁদ মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। এক্ষেত্রে দুদকের অর্জন বলা যায় ‘শূন্য’।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে দুদকের মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সময়ে সংস্থাটি ৪৫২টি দুর্নীতি মামলা করেছে। যেখানে আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দুইশর বেশি হেভিওয়েট ব্যক্তিকে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা এক হাজার ৭৪৩ জন।
গত এক বছরের মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে দুদকের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই মামলাগুলোর মধ্যে রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।’
গত বছরের আগস্টের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দুর্নীতি নিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলেও এসময়ে দুদক কোনো ফাঁদ মামলা করেছে, এমন তথ্য নেই সংস্থাটি কাছে। অর্থাৎ, এক বছরে ফাঁদ মামলায় দুদকের অর্জন ‘শূন্য’
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দুদক বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ৪৫১টি মামলা ও ৪০৩টি চার্জশিট দাখিল করে। আলোচ্য সময়ে এক হাজার ৯৮৪টি অভিযোগ অনুসন্ধান করে। ২০২৩ সালে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ৮৪৫টি অনুসন্ধান করে দুদক। ওই বছর কমিশন ৪০৪টি মামলা ও ৩৬৩টি চার্জশিট দাখিল করেছিল।
আক্তার হোসেন বলেন, ‘আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করছে দুদক। অভিযোগ আমলযোগ্য হলে সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে দুদকের মামলায় প্রথমবারের মতো সরাসরি আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন- সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানায়, গত এক বছরে কমিশন ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ৪৫২টি মামলার পাশাপাশি ৩৪৮টি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে। এসব চার্জশিটে আসামির সংখ্যা এক হাজার ৪৪৩ জন।
দুদকের করা মামলাগুলোর মধ্যে রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।- আকতারুল ইসলাম
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছরে এত বিপুল সংখ্যক মামলা ও চার্জশিট দাখিল করার নজির সংস্থার দীর্ঘদিনের ইতিহাসে নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন মহাপরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কমিশন এবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে পেরেছে। এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন।’
তবে বিষয়টি ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলছেন, এই অভিযান সুশাসনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। আবার অনেকে এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেও আখ্যায়িত করছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে এ বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়েছে।
গত এক বছরে দুদকের অসংখ্য মামলা ও অভিযোগপত্র দায়ের হলেও এসব মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলা দায়ের করাই শেষ কথা নয়। বাস্তব চ্যালেঞ্জ হলো—আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করে দোষীদের দণ্ড নিশ্চিত করা।’
তিনি বলেন, ‘দুদক অতীতে অনেক তাড়াহুড়ো করে মামলা করেছে। যেগুলোর মান ভালো না হওয়ায় অনেকসময় হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গেছে। গুণগত মান নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’
‘দুদকের পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও এই সংস্থা কতটা কার্যকর, তা প্রমাণ হবে বর্তমান সময়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তার অবস্থানে। অতীতে সংস্থাটি যেভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অনুকূলে কাজ করেছে, এবারও যেন একই চিত্র না হয়’- যোগ করেন সংস্থাটির সাবেক এ কর্মকর্তা।
মামলা করাই শেষ কথা নয়। বাস্তব চ্যালেঞ্জ হলো—আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করে দোষীদের দণ্ড নিশ্চিত করা। দুদক অতীতে অনেক তাড়াহুড়ো করে মামলা করেছে। যেগুলোর মান ভালো না হওয়ায় অনেক সময় হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গেছে। গুণগত মান নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।- মঈদুল ইসলাম
এই নজিরবিহীন উদ্যোগের ফলে দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট হলেও এখন নজর বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর। মামলাগুলোর আইনি পরিণতি কতটা স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে—সেটাই দেখার বিষয় বলে মনে করছেন অনেকে।
দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরার বেশ কার্যকর একটি কৌশল হচ্ছে দুদকের ‘ফাঁদ মামলা’। তবে গত বছরের আগস্টের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দুর্নীতি নিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলেও এসময়ে দুদক কোনো ফাঁদ মামলা দায়ের করেছে, এমন তথ্য নেই সংস্থাটি কাছে। অর্থাৎ, এক বছরে ফাঁদ মামলায় দুদকের অর্জন ‘শূন্য’।
গত সাত বছরের মধ্যে ফাঁদ মামলা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামে ২০২৪ সালে। গত বছর এরকম একটি মামলাও করতে পারেনি সংস্থাটি। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
এর আগে ২০২৩ সালে তিনটি, ২০২২ সালে চারটি, ২০২১ সালে ছয়টি, ২০২০ সালে ১৮টি, ২০১৯ সালে ১৬টি ও ২০১৮ সালে ১৫টি ফাঁদ মামলা করেছিল দুদক।