Image description
থেমে নেই যন্ত্রাংশ আমদানি

ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান-রিকশা। এই যানটি এখন ঢাকা শহরের গলার কাঁটা। রাস্তায় বের হলেই পায়ে পায়ে অটোরিকশা। মোটর লাগিয়ে হাওয়ার গতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গলিরাস্তা থেকে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক। ঝুঁকিপূর্ণ এই যানের নিয়ন্ত্রণহীন বিচরণে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। ট্রাফিক পুলিশ থেকে সরকার, সবাই যেন অসহায় এই অটোরিকশা চালকদের কাছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত এসব অটোরিকশার যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বন্ধ না করা গেলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।    

বেসরকারি হিসাবে অটোরিকশার সংখ্যা বর্তমানে ৫০ লাখের ওপরে দাঁড়িয়েছে। বসিলা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, মুগদা, মাণ্ডা, গোড়ান, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ অটোরিকশা তৈরির ওয়ার্কশপ। কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগান এলাকাতেই অর্ধশত ওয়ার্কশপে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ছোট-বড় এসব ওয়ার্কশপে তৈরি হচ্ছে অটোরিকশার বডি। আর এই মূল যন্ত্রাংশ ব্যাটারি ও মোটরের জোগান মিলছে কমলাপুর স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে। রীতিমতো এলসি খুলে, শুল্ক দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে এসব অটোরিকশার যন্ত্রাংশ। যা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাড়া-মহল্লার দোকানে দোকানে। অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে এসব যন্ত্রাংশ। যার বাজারও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। 

হাজারীবাগ বালুর মাঠ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় একাধিক অটোরিকশা তৈরির ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। চিকন চাকা, মোটা চাকা, ডিজিটাল ডিসপ্লেসহ বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ওয়ার্কশপের গোডাউনগুলোতে রয়েছে নতুন নতুন অটোরিকশা। মো. মিজানুর রহমান নামে এক ওয়ার্কশপের মালিক বলেন, মূলত অটোরিকশার মোটরসহ মূল যন্ত্রাংশগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমরা এসব আমদানিকারকদের কাছ থেকে কিনে আনি। আর ব্যাটারি বর্তমানে বাজারে পর্যাপ্ত। সব পার্টস কিনে এনে আমরা শুধু এই ওয়ার্কশপে ফিটিং করি। বডিতে রঙ করি।  কাজের যখন চাপ থাকে তখন দিনে ১০-১২টাও অটোরিকশাও বানানো হয়। যা একেকটি ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এদিকে কেরানীগঞ্জ এলাকাতেও ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০-৬০টি অটোরিকশা তৈরির কারখানা রয়েছে। এই ওয়ার্কশপগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অটোরিকশার বিভিন্ন পার্টসের দোকান। মোর্শেদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, এখানে আমরা প্রায় ৫শ’-৬শ’ মানুষ অটোরিকশা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সাধারণত আমাদের টার্গেট এখন ঢাকার বাইরে। 

এদিকে তানভীর নামে বনশ্রী এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের এই বনশ্রীর মেইন রাস্তায় অটোরিকশার ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, রামপুরা টু ডেমরার মেইন সড়কের উপর প্রায়ই অটোরিকশাগুলো এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো আবার এসব চালকরা কোনোদিকে খেয়াল না করে রাস্তার মাঝ দিয়ে সজোরে ছুটে চলে। কাউকেই সাইড দেয় না। এতে বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় যানজট লেগে থাকে। সানজিদা ইয়াসমিন নামে ধানমণ্ডি এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ঢাকা শহরে এখন মানুষ থেকে অটোরিকশা বেশি। একটা রিকশা ডাক দিলে অন্তত ২০টা রিকশা এসে হাজির হয়। রিকশার জ্বালায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা দায়। তারা রাস্তায় যখন চলে, মনে হয় তারা অন্ধ-বধির। কিছু শোনেও না, দেখেও না। অনিক নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, কয়েকদিন আগে ধানমণ্ডি ১৯ নম্বরে কোনো সিগন্যাল-সংকেত ছাড়াই হঠাৎ পাশের এক গলি থেকে একটি অটোরিকশা চালক রাস্তার বিভাজক টপকে এসে আমার বাইকে মেরে দিলো। এতে আমার হাত ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। অনিক বলেন, এই সব অটোচালকরা রাস্তার মাঝে যা খুশি করে বেড়ায়। মাঝ রাস্তায় বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা এদের হাত থেকে মুক্তি চাই। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ ছাড়া এসব রিকশার কাঠামো ও চাকা অনেক দুর্বল, দ্রুতগতিতে চলাচলের উপযোগী নয়। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে অটোরিকশার বাজার বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। চাইলেই এখন আর এ বাহনকে নিষিদ্ধ করার উপায় নেই। এই অটোরিকশার ব্যাপকতা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে বিজ্ঞানভিত্তিক এটা করতে হবে। রাতারাতি হঠাৎ করে যদি বলা হয় যে, ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে নামবে না, এটা আসলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।