
দেশে এডিস মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। ডেঙ্গুর পাশাপাশি শনাক্ত হচ্ছে চিকুনগুনিয়া। চলতি বছর গতকাল বুধবার পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে ২৫৩ জনের। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার প্রায় ৪৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া রোগী বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা সহজলভ্য করা এবং এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সরকারের গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য মতে, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৫৩ জনের দেহে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দারা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে মহাখালী, তেজগাঁও, নাখালপাড়া, খিলক্ষেত, নিকেতন, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, উত্তরা, লালবাগ, আজিমপুর, হাজারীবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, খিলগাঁও, মুগদা, গোড়ান, রামপুরা ও শাহজাহানপুরে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, এডিস মশা দুই ধরনের—এডিস অ্যালবোপিকটাস ও এডিস ইজিপটাই।
সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা সীমিত : দেশে চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে বলে আগেই সতর্ক করেন গবেষকরা। তবে বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। সরকারি পর্যায়ে শুধু ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও আইইডিসিআরের বাইরে কোথাও রোগটি পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। সারা দেশে পরীক্ষা বন্ধ আছে প্রায় আট বছর।
২০২৪ সালের শেষ ভাগে সংক্রামক রোগ বিষয়ক গবেষণার জন্য পরিচিত ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজেস রিজিয়নস’ (আইজেআইডি রিজিয়নস) জার্নালে ‘দ্য রি-অ্যাপিয়ারেন্স অব চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ, ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, এডিস মশাবাহিত চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ২০২৫-২৬ সালে বাড়তে পারে।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আইইডিসিআরে এপিডেমিওলজি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, ৯৬ শতাংশের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, ২৯.৪ শতাংশের ক্লান্তি, ১৯ শতাংশের অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া ছিল। এ ছাড়া জ্বর, পেশিতে ব্যথা ও মাথা ব্যথা ছিল।
আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, ফলোআপে থাকা রোগীদের ৮১ শতাংশের ২৮ দিন পরও দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ (জয়েন্ট পেইন) ছিল। এ ছাড়া রোগীরা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের কারণে গড়ে ১০.৫ কর্মদিবস হারিয়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু দৈনিক আয় ৬.৯৮ মার্কিন ডলার ধরে প্রত্যেকে গড়ে ৭৩.৩ ডলার আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. হালিমুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, ২০১৭ সালের পর কেন্দ্রীয়ভাবে হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার কিট কেনা হয়নি। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছেও কোনো বাজেট নেই। পরিস্থিতি বেগতিক হলে হাসপাতালগুলো নিজ উদ্যোগে তার বাজেট থেকে কিট কিনে পরীক্ষা করবে।’
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটা পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা শনাক্ত করতে পারি। তাই আলাদাভাবে পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এবার চিকুনগুনিয়া রোগী কিছুটা বেশি পাচ্ছি। তবে কারো মৃত্যু হয়নি।’
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে এডিস মশাবাহিত রোগ আরো জটিলতর এবং অনেক সমস্যাবহুল হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হয়, মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী ৩০-৪০ বছর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা হতে থাকবে।’