
ত্রিশটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। মোট ৬৮ দিনের আলোচনা শেষ হবে আজ। এই আলোচনা শেষে আজই চূড়ান্ত হচ্ছে জুলাই সনদ। একইদিন
সনদের খসড়া হাতে পাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। পর্যালোচনার পর এই সনদে দলগুলো স্বাক্ষর করলেই এটি একটি জাতীয় দলিলে পরিণত হবে। তাই এই সনদ সইয়ের ক্ষেত্রে বল এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। শেষ মুহূর্তে দলগুলোর মধ্যে সনদে সই নিয়ে টানাপড়েন রয়েছে।
৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এই লক্ষ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। সংস্কার কমিশনগুলোকে একত্রিত করে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ২০শে মার্চ থেকে ১৯শে মে পর্যন্ত প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। ২রা জুন দ্বিতীয় দফার বৈঠক শুরু করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন কমিশন। কমিশনের পুরো কাজের সমন্বয়ক করছেন সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ। দীর্ঘ সময়ের আলোচনার বিষয়বস্তু, ঐকমত্য ও দ্বিমতের বিষয়গুলো আজ কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হবে। কমিটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, দু’টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। এখনো ৮টি বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। সনদ চূড়ান্ত করতে দলগুলোকে প্রথমে কমিশন যে খসড়া দেয় সেটি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এটিকে অগ্রহণযোগ্য এবং ভিত্তিহীন কাঠামো বলে জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তারা খসড়া সনদের বিষয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছে। তাদের অভিযোগ- মৌলিক সংস্কার, বাস্তবায়ন কাঠামো এবং আইনি ভিত্তি এই তিনটি মূল স্তম্ভের কোনোটি নিয়েই খসড়ায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভবিষ্যতের রাষ্ট্রগঠন ও রাজনৈতিক সংস্কারকে শক্তিশালী ও বাস্তবায়নযোগ্য কাঠামোয় উপস্থাপন করা। কিন্তু খসড়ায় তার কোনো প্রতিফলন নেই। দলগুলো আরও বলছে, আইনগত ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কাঠামো ছাড়া সনদের কোনো ভিত্তি নেই। কমিশন কেন পরবর্তী সংসদের হাতে বাস্তবায়নের ভার ছেড়ে দিবেন। তাহলে কেন এতদিন ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা মিলে আলোচনা করা হলো, এই সময়ের কী কোনো মূল্য নেই?
বিএনপি বলছে, খসড়ায় দুই বছরের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার যে কথা বলা হয়েছে তাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায় দলটি।
বুধবার বিকালে কমিশনের দ্বিতীয় দফায় ২২তম দিনের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ছিল- সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায়পাল সংক্রান্ত বিধান। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি ও ইলেক্টোরাল কলেজ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার জুলাই সনদের গ্রহণযোগ্য খসড়া সব দলের কাছে তুলে দেয়া হবে। আজকের মধ্যে আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেবো। আশা করছি, আগামীকাল আমরা একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দিতে পারবো।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে অতীত অভিজ্ঞতার কারণে আমরা এখানে সংস্কারের জন্য বসেছি। সেটি হলো দেশে যাতে আর কোনোভাবে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব না হয়। আমরাই প্রস্তাব দিয়েছি, কোনো ব্যক্তি যাতে দশ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে না পারে। নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে নির্বাহী বিভাগের যাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকে-সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব না হওয়ার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা বলেছি। রক্ষাকবচ হিসেবে পৃথিবীর সবদেশে স্বাধীন বিচারবিভাগ আবশ্যিক। এটা আমরা নিশ্চিত করতে বলেছি। আরেকটি হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
সালাহউদ্দিন বলেন, নারী আসনের ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, আমরা ম্যান্ডেট পেলে নারীর আসন ৫০ আছে, সেটা আমরা ১০০তে উন্নীত করবো। তবে নির্বাচন পদ্ধতি হবে আগের মতো। এ বিষয়টি ঐকমত্য কমিশনে ঐকমত্য হয়নি বললেই চলে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এর দায়িত্ব আগামী সংসদের ওপর দেয়া অর্থহীন। অনেকে বলছেন, আইনি ভিত্তির সম্ভাবনা নেই। আমরা বলবো, তাহলে এর দরকার নেই। সংসদে নারী আসনের বিষয়ে দলটির অবস্থান নিম্নকক্ষের সদস্যদের আনুপাতিক হারে বণ্টনের পক্ষে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে এতদিনের বৈঠকে খাওয়া-দাওয়া, আর আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দেয়া সম্ভব নয়। এটি ঠিক নয়- কারণ তিনটি পদ্ধতিতে দেয়া যায়। এক লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, গণভোট ও রেফারেন্ডাম।
জামায়াতের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনিরও এ বিষয়ে গণভোট, রেফারেন্ডাম ও লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ সরকারের সবচেয়ে বড় ভিত্তি জনগণের অভিপ্রায়। গত ৫ই আগস্ট জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। আর সরকার এসেছে ৮ই আগস্ট। তাই সরকারের দায়িত্ব গঠন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬-এর বা সুপ্রিম কোর্টের ভিত্তিতে হয়নি। তাই সরকার চাইলে সংবিধানের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে পারে।
আইনগত ভিত্তি ছাড়া সনদ গ্রহণযোগ্য নয় বলছে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন: জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ মানবজমিনকে বলেন, জুলাই পরবর্তী সংস্কারগুলোতে একমত, দ্বিমত এবং আংশিক একমত সবধরনের মতোই এসেছে। কিন্তু এই অভিমতগুলো খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বলা হয়েছে, পরে যুক্ত করা হবে। এটা করলে তো সনদটা পূর্ণাঙ্গ হবে না।
তিনি বলেন, শুধু একটি লিখিত দলিল প্রকাশ করলেই চলবে না, সেটিকে কার্যকর ও টেকসই করতে হলে এর একটি দৃঢ় আইনগত কাঠামো থাকা জরুরি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি বলা হয়, আগামী দুই বছরে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। তাহলে এতদিন রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকারি প্রতিনিধিরা এত সময় ও শ্রম দিয়ে কী করলো? রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদের কি কোনো মূল্য নেই?
হামিদুর রহমান স্পষ্ট করে বলেন, পলিটিক্যাল এগরিমেন্ট বাংলাদেশে টিকে নাই, সুফলও আনে নাই। বরং জটিলতা তৈরি করেছে। তাই আবার সেই ব্যর্থতার পথে যেন না হাঁটে কমিশন, সেটা নিশ্চিত করতেই হবে। নইলে আবার নতুন সংকটের জন্ম নেবে।
ওদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন মানবজমিনকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি, দু’টি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে; প্রথমত, মৌলিক সংস্কার কী হবে; দ্বিতীয়ত, এই সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী। কিন্তু পদ্ধতিগত আলোচনা না করেই আমাদের হাতে খসড়া ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা এই খসড়ার তীব্র বিরোধিতা করি।
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এই খসড়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও স্পষ্ট নয়। যদি একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আমরা এই সনদে স্বাক্ষর করবো না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, পরবর্তী সরকার এসে যে এই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন, এর গ্যারান্টি কে দিবে? জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনা করে কী লাভ হলো, এটা শুধুই দলিল আকারে থাকবে নাকি বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ঐকমত্য ও দ্বিমতের বিষয়গুলো: দ্বিতীয় দফায় বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া গেছে। সেগুলো হলো- এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এমন বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন। এতে অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিএনপি’র নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব। এতে সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি-এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ সংসদে আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে ক’টি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা জারি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা হবে, পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে একটি ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠন করা হবে, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে, একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, এ প্রস্তাবে তিন-চতুর্থাংশ দল একমত। বিএনপিসহ যারা একমত হয়নি, তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে।
প্রথম পর্বের আলোচনায় বেশ কিছু সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল। তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন থেকে জানানো হয়নি। জুলাই সনদে এ বিষয়গুলোও যুক্ত করা হবে।
যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো হলো- সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পদ্ধতি, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি ও ক্ষমতা, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচনপদ্ধতি, রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি, রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো, সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব।