Image description

গত ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে গাইবান্ধার সাঘাটা থানার পাশের পুকুরে স্থানীয় এক শিবির নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন লাশ উদ্ধারের পর থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য লক্ষ করা গেছে। গত কয়েক দিনে প্রকাশিত তথ্য এবং আমার দেশের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, সিজু হত্যার মূলহোতা সাঘাটা থানার এএসআই রাকিব। আর সহকর্মীর সংশ্লিষ্টতা ঢাকতে থানার ওসি ও অন্যরাও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

পুকুরে সাঁতার কাটা অবস্থায় সিজুকে লম্বা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশের প্রাথমিক দাবি নাকচ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পুলিশের বক্তব্যও পাল্টে যায়। বিশেষ করে, থানার ওসি বাদশা আলম দুই রকমের বক্তব্য দেন। এমনকি তিনি পূর্বনির্ধারিত ছুটিতে থাকারও দাবি করেন। আবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিদ্রোহ কুমার কুন্ডুও ওসিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

গভীর রাতে পুকুরের পানিতে সাঁতরানো অবস্থায় সাপের মতো একটি মানুষটিকে পেটানোর চাঞ্চল্যকর ভিডিও পরের দিন (২৫ জুলাই) প্রকাশ পাওয়ার পর বিস্মিত হয় এলাকার মানুষ। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে-

সেদিন থানায় সিজুর সাথে এমন কী ঘটেছিল, কেন তাকে হত্যা করতে হলো? পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে কেন বলা হলো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? কেন সেদিন বলা হয়েছিল- সে মানসিক ভারসাম্যহীন?

সাঘাটা থানায় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পুকুরের পানিতে লাফিয়ে পড়া সিজুর লাশ উদ্ধারের পর এমন বহু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাহলে কি পুলিশ ও স্থানীয় চিহ্নিত অথচ অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকজন মিলেই তাকে পুকুরের পানিতে পিটিয়ে হত্যা করে- এমন প্রশ্ন সবার। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে পুরো জেলায়। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে থানার চৌহদ্দিতে এমন ঘটনায় হতবাক হয়েছে মানুষ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের ইউনিয়ন সভাপতি এভাবে হত্যার ঘটনায় নতুন করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অথচ ফ্যাসিবাদ পতনে অন্যান্য দলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ছাত্র সংগঠনটি।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাত ১০টার দিকে গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় ঢুকে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মহসিন আলীকে ছুরিকাঘাত করে দৌড়ে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেন সিজু মিয়া। পরদিন শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাঘাটা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই পুকুরের কচুরিপানার মধ্য থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সিজুর লাশ উদ্ধার করে। পরে তার পুরো পরিচয় মেলে।

সিজু গাইবান্ধা সদরের গিদারী ইউনিয়নের বাগুরিয়া গ্রামের দুলাল হোসেন ও রিক্তা দম্পতির একমাত্র ছেলে। তিনি ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবির গাইবান্ধা সদরের গিদারী ইউনিয়ন শাখার সভাপতিও ছিলেন সিজু। ছিলেন মেধাবী ছাত্র।

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ফেরদৌস সরকার রুম্মান বলেন, এমন একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা হতভম্ব। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তবে দলীয়ভাবে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় জানানো হবে।

পুকুরের পানিতে সিজু মিয়ার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে যখন চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ও অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম হতে থাকে, ঠিক তার পরদিন শুক্রবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুড়িরে দেয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সিজু মিয়া সাঁতরে পুকুরের পাড়ে উঠার চেষ্টা করছেন, আর সে সময় পুকুরে নৌকা থেকে তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। ভাইরাল হওয়া এই ভিডিও এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।গত শনিবার দুপুরের পর নিহতের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে তার নিজ বাড়ি বাগুরিয়া গ্রামে।

পুকুর থেকে সিজুর লাশ উদ্ধারের দিন থেকেই সাঘাটা থানার গেটের সামনে সাব্বির স্টোরসহ কয়েকটি দোকান বন্ধ রয়েছে। নিহত সিজু পুকুরের পানিতে সাঁতরানো অবস্থায় যারা নৌকা নিয়ে কাছে গিয়েছিল, তারা কি তাকে হত্যায় সহায়তা করেছে? নাকি বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছেন? বন্ধ থাকা এসব দোকানের মালিকসহ এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে।

নিহত সিজুকে পুকুরের পানিতে পেটানোর ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকাবাসীর অভিযোগ, তাকে পুকুরের পানিতেই পিটিয়ে মারার পর মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে পুলিশ। তবে তাকে পেটানোর ভিডিওতে স্পষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি।

ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সাঘাটা থানার ওসি বাদশা আলম বলেছিলেন, ‘ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন। সে পুলিশ কে এলোপাথারি আঘাত করে এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও ওই রাতে আর কিছু তিনি জানতে পারেননি। পরদিন সকালে তার লাশ উদ্ধার হয়।

ওই দিন বিকেলে সাঘাটা থানায় প্রেস ব্রিফিং করেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) বিদ্রোহ কুমার কুন্ডু।

ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ওই যুবক থানায় এসে মোবাইল হারানোর সাধারণ ডায়েরি করতে চান। তারপর ৯টা ৫৬ মিনিটে থানায় চাকু হাতে এসে এক হাবিলদারের নিকট থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে বাধা দিতে গেলে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মহসিন আলীকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় এবং পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়।’

ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন না থানার ওসি বাদশা আলম। তার অনুপস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বিদ্রোহ কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওসি সকালে সাক্ষ্য দিতে গেছে।’ এ সময় সাংবাদিকরা শুক্রবার বন্ধের দিন স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি পরে সবকিছু জানাবেন বলে ব্রিফিং শেষ করেন।

সাঘাটায় শিবির নেতা হত্যা, তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠনসাঘাটায় শিবির নেতা হত্যা, তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন
নিহতের মা রিক্তা বেগম ও মামা শাহ আলম জানান, কিছুদিন আগে গাইবান্ধার জুনায়েদ টেলিকম থেকে একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সেট কিনে নেন সিজু। এরপরই গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রমজান আলীকে সাঘাটা থানা থেকে এএসআই রাকিব জানান, সিজু অন্য মানুষের একটি মোবাইল কিনেছেন। তাকে ওই মোবাইল ফেরত দিতে হবে। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে গাইবান্ধা রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে রমজানের উপস্থিতিতে এএসআই রাকিব ও কনস্টেবল আজাদের কাছে ওই মোবাইল ফোনটি হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যায় সিজু তার মাকে জানান, যে দোকান থেকে মোবাইল কিনেছিলেন সেখানে কথা বলতে যাচ্ছেন। কিন্তু রাতে আর বাসায় ফেরেননি। তার ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

ইউপি সদস্য রমজান আলী বলেন, সাঘাটা থানা থেকে এএসআই রাকিব ফোন করে জানান, সিজুর কাছে একটি মোবাইল ফোন আছে। মোবাইল ফোনটি উদ্ধারে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। আমি (ইউপি সদস্য) তাকে বলি, সিজু আমার ভাতিজা হয়। সমস্যা হবে না। আপনার মোবাইল ফোন দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে ওই পুলিশের কাছে সিজুর পরিবার মোবাইল ফোনটি ফেরত দেয়।

মোবাইল ফোন জব্দ করা এএসআই রাকিব জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে সিজুর কাছ থেকে একটি হারানো মোবাইল উদ্ধার করা হয়। কিন্তু রাতে কেন থানায় গিয়েছিল সিজু? এমন প্রশ্নে আর কিছু বলতে রাজি হননি রাকিব।

এদিকে জুনায়েদ টেলিকমের মালিক জুনায়েদ বলেন, ওই মোবাইল ফোনটি আমি সরাসরি বিক্রি করিনি। আমার পরিচিত একজনের কাছ থেকে কিনে দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিজু দোকানে আসে। মোবাইল ফোন পুলিশ নিয়ে গেছে বলে জানান। তাই তিনি টাকা ফেরত চান। এ কথা শুনে দোকানদার এএসআই রাকিবকে ফোন দেন। এ সময় এএসআই রাকিব কাগজপত্র নিয়ে থানায় যেতে বলেন।

জুনায়েদ আরও বলেন, ‘সন্ধ্যায় সিজু ও তার এক বন্ধুসহ সাঘাটা থানায় যাই। ২ ঘণ্টা ধরে বসে রেখেও এএসআই রাকিব আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। রাত ৯টা বেজে গেলে আমরা বাড়ি ফিরে আসি সিজুকে বলে। সিজু বলে তোমরা চলে যাও। বাধ্য হয়ে তাকে রেখে আমরা চলে আসি।’

শুক্রবার লাশ উদ্ধারের দিন এক প্রশ্নের জবাবে সাঘাটা থানার ওসি বাদশা আলম জানান, সিজু মানসিক ভারসাম্যহীন নন। সাঁতারও জানেন। অথচ একদিন আগে তিনিই সিজুকে মানসিক ভারসাম্যহীন দাবি করেছিলেন।

নিহত সিজুকে পুকুরের পানিতে পেটানোর ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আমি আসলে ওই দিন ছুটিতে ছিলাম। তাই বলতে পারছি না।’

এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুরে সিজুকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন তিনি।

পরে দুপুর ৩টার দিকে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য ইতোমধ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এডিশনাল ডিআইজি জানান, আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এদিকে, বুধবার রাতে সাঘাটা থানার ওসি বাদশা আলমকে এএসআই রাকিবের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘এএসআই রাকিব কর্তৃক সিজুকে থানায় ডেকে আনার কোনো তথ্য বা ভিডিও আমরা পাইনি। তবে মোবাইল কেনা সংক্রান্ত বিষয় সামনে আসায় ২৬ জুলাই তাকে ক্লোজ করে গাইবান্ধা পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ওই সময় আমি ছুটিতে থাকায় অফিশিয়াল ফোনে কখন কি ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা বলতে পারছি না।