Image description
ধার শোধ করতে না পেরে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন

গাইবান্ধা বোনারপাড়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জাহিদুল ইসলাম মন্ডল অবসরে গেছেন ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি। তিনি সম্প্রতি স্ত্রীসহ হজ পালন করে দেশে ফিরেছেন। হজ পালনের জন্য তিনি চলতি বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন। এই শিক্ষকের আবেদন গ্রহণ করে হজে যাওয়ার আগে টাকা পরিশোধ করার আশ্বাস দেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। কিন্তু আজ অবধি তিনি টাকা পাননি। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধারদেনা করে তিনি হজ পালনের উদ্দেশে রওনা দেন।

দেশে ফিরে এসে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সহকারী অধ্যাপক মো. জাহিদুল ইসলাম মন্ডল। তার মতো প্রায় চারশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর একই অবস্থা। হজযাত্রীরা দেশে ফিরে বিশ্রামে গেলেও এ শিক্ষকরা পড়েছেন বিপদে। হজ পালন শেষে তারা এখন প্রতিদিন ভিড় করছেন বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সামনে। হজে যাওয়ার আগে তাদের অর্থ পরিশোধ করার আশ্বাস দিলেও এখনো তাদের টাকা দিচ্ছে না। প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়ার আশায় অনেকেই ঋণ করে হজে গেছেন। হজ শেষে ঋণ পরিশোধ করার কথাও ছিল অনেকের। প্রতিদিন এসে অসহায়ের মতো ঘুরছেন এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা। অন্যান্য বছর হজের আবেদন মানবিক বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধ করা হলেও এবার ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।

জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা চাকরিজীবনে মূল বেতনের ৬ শতাংশ অবসর সুবিধা বোর্ডে ও ৪ শতাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে জমা দিয়ে থাকেন। তাদের জমাকৃত অর্থে সরকার একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে অবসরের পর এই সুবিধার অর্থ দেন শিক্ষক-কর্মচারীদের। চাকরি বয়স শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসরে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু অবসরান্তে কল্যাণ ট্রাস্টের ভাতা সহজে মিলে না। এই টাকার জন্য নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। তিন বছর আগে যারা অবসরে গেছেন তারাও এখনো টাকা পায়নি। তিন দশকের কর্মজীবন শেষে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রায় ৪০ হাজার এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। যদিও এরমধ্যে অনেক আবেদন মানবিক বিবেচনা নেওয়া হয়। তাদেরকে আগেভাগে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে বিশেষ বিবেচনায় ৪২০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ হজে বা তীর্থে গেলে তাদের বিষয়গুলো মানবিক বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু এবার যারা হজ ও তীর্থে গেছেন তাদের আবেদন গ্রহণ করা হলেও টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না। বর্তমানে হজ পালন করা ও তীর্থে যাওয়া ৪০২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ট্রাস্টে আবেদন জমা রয়েছে। এই আবেদনের অর্থ পরিশোধ করতে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। কল্যাণ ট্রাস্ট চাইলে এই অর্থ যে কোনো সময় পরিশোধ করতে পারে। অথচ এই টাকা পরিশোধের আশ্বাস দিলেও অদৃশ্য কারণে তা আটকে গেছে। প্রতি বছর হজে যাওয়ার আগে এই টাকা পরিশোধ করা হয়। কোনো কারণে বিলম্ব হলে হজ শেষ হওয়ার আগেই আবেদনকারীর নিজ অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায়। এবার এই ধরনের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অবসরে যাওয়া শিক্ষকরা।

ভুক্তভোগী এক শিক্ষক বলেন, অবসর ও কল্যাণের টাকার জন্য ঘুস দিতে হয়। অন্যথায় হয়রানির শিকার হতে হয়।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) ড. শরিফা নাছরীন যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা দিতে আমাদের সদিচ্ছার কমতি নেই। তবে অবসরে যাওয়া ১৫২ শিক্ষক-কর্মচারীর হজের টাকা প্রদানের জন্য একটা ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বাদ-বাকিদের টাকা পরিশোধের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফান্ডে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের যথাসময়ে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ৪৯ হাজার শিক্ষকের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বাজেটে এই খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। গত বাজেটে মাত্র ২০০ কোটি টাকা বন্ড দেওয়া হয়েছে কল্যাণ ফান্ডে, যার শুধু ইন্টারেস্টের অংশ ব্যবহার করা যাবে। কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ২০২২ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের আবেদনের টাকা ইতোমধ্যে ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এপ্রিলের আবেদনের অর্থ ইতোমধ্যে ইএফটির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এর পরের আবেদনগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়ে গেছে।

জানা যায়, চাকরি ছাড়ার পর এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের পাওনা টাকা না পাওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে মানুষ গড়ার এই কারিগরদের শেষ জীবন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে চিকিৎসা দরকার। কারওবা সন্তানের লেখাপড়া কিংবা মেয়ে বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে সবই আটকে আছে কিংবা ধারদেনা করে কাটাতে হচ্ছে। অবসরে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে মারা গেছেন অনেকে। এছাড়া অনেকে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। অথচ পেনশনের ফাইলে বন্দি শিক্ষাগুরুদের জীবন। লাঠি ভর করে সকাল থেকে বিকাল, মাইলের পর মাইল পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইট-পাথরের রাজধানীতে চক্কর কাটছেন কর্মজীবন শেষে প্রাপ্য অবসর ভাতাটুকুর জন্য। বয়সের ভারে মানুষ গড়ার নুইয়েপড়া কারিগররা বড় অসহায়। এসব দেখার কেউ নেই!