
রাজধানীর মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ে ২৭ জুন দুপুরে বেপরোয়া গতির একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক বিভাজনে উঠে পড়ে। এ সময় আনিসুজ্জামান নামের এক পথচারীকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় গুরুতর আহত হন অপর এক পথচারী। এর আগে ২ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের সামনে বাসের সঙ্গে দুটি মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১১ জন প্রাণ হারান।
এভাবে দেশের সড়কগুলো হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। সড়কের দুর্বল অবকাঠামো, ত্রটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অনভিজ্ঞ ও মাদকাসক্ত চালক এবং প্রধান সড়কগুলোতে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু গেল জুনেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭১১ জনের মৃত্যু এবং ১ হাজার ৯০২ জন আহত হয়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়ছে অনেক পরিবার। পঙ্গুত্ববরণ করা অনেকে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে বেঁচে আছেন।
দুর্ঘটনায় হতাহত কমাতে সড়কে ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচও’ (সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার একটি পদ্ধতি) গ্রহণ করা হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশই সড়কে এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ হলো সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার একটি পদ্ধতি, যার মূল লক্ষ্য-সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা। এই পদ্ধতিতে মানুষ ভুল করতে পারে এ বিষয়টি মাথায় রেখে সড়ক ও যানবাহন এমনভাবে নকশা করা হয়, যাতে ছোটখাটো ভুল বা অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা ঘটলেও তাতে কেউ গুরুতর আহত বা নিহত না হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সড়কে মানুষের জীবন এখন মূল্যহীন। ত্রুটিপূর্ণ রোড ইঞ্জিনিয়ারিং, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানোয় বাড়ছে দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালে সরকার ‘মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা’ জারি করলেও তা প্রয়োগের নির্দেশনা না থাকায় তার সুফল মিলছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মামলার এক শতাংশেরও চূড়ান্ত বিচার হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তারা।
ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসাইন যুগান্তরকে বলেন, আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেশি। এতে হতাহতের সংখ্যাও বেশি। ফলে সবার আগে নিরাপদ সড়ক দরকার। সড়ক নির্মাণের সময় সেফটি ফিচারগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে রোড ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে সড়ক পরিবহণ আইন আছে তার মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়টি উপেক্ষিত। সেজন্য একটা এক্সক্লুসিভ সড়ক নিরাপত্তা আইন হওয়া দরকার।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৬ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯ জন। এর আগে ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৯১১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫২৪ জন নিহত ও ১১ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯ দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হয়েছেন।
সম্প্রতি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ২৩% পথচারী ও ৪.২% সাইকেলচালক বা আরোহী।
গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য রোডের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ৬ মাসেই সারা দেশে ১৭ হাজার ৯৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৮ জন আর আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮২৬ জন।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের বিষয়গুলো সড়ক নিরাপত্তায় ব্যবহার করে মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে। যেমন-সুইডেনে প্রতিলাখে মৃত্যুর হার মাত্র ২.৮। এছাড়া ডব্লিউএইচও-এর ৭টি অঞ্চল সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের ব্যবহার করে মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় অঞ্চলে সড়কে মৃত্যুর হার ৩৬% হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একাধিক দেশে মৃত্যুর হার ১৫% হ্রাস পেয়েছে।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেফটি প্রকল্প সমন্বয়কারী শারমিন রহমান যুগান্তরকে বলেন, ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংঙ্কিং অনুসারে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। রোডক্র্যাশে (সড়ক দুর্ঘটনা) মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল আরোহী। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ ছাড়া দেশে রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব নয়।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়, সেগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় না। বেশির ভাগই মীমাংসা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মামলার সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে দুর্ঘটনার বিচার খুবই কম হয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার এক শতাংশ মামলারও চূড়ান্ত বিচার হয় না। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে যে সড়ক পরিবহণ আইন হয়েছে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা মামলা করার বিধান যুক্ত হয়। কিন্তু সেটির বিষয়ে মালিকপক্ষের আপত্তির কারণে ওই আইন এখনো পুরোপুরি কার্যকরী হয়নি। দোদুল্যমানতার মধ্যেই আছে। যদি নতুন আইনটি পুরোপুরি কার্যকরী হয় তাহলে সাজা নিশ্চিত হবে।