
ঢাকায় পাথরের আঘাতে নিহত ব্যবসায়ী সোহাগের (৩৯) দাফন হয়েছে নিজ জেলা বরগুনায়। ভয়, আতঙ্ক আর ক্ষোভ নিয়ে অনেকটা গোপনেই দাফন হয়েছে সোহাগের। গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে তড়িঘড়ি করে ছোট পরিসরে নামাজে জানাজা শেষে তার নানাবাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৭ নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের ইসলামপুর নামক এলাকায় তার মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের মৃতদেহ নিয়ে আসেন স্বজনরা। নিহতের স্বজনদের দাবি, হত্যাকারীরা মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল সোহাগের কাছে। এদিকে, মামলায় হত্যাকারীদের বাদ দিয়ে পুলিশ তড়িঘড়ি করে স্বাক্ষর নিয়েছে বাদীর। বাবা সোহাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকারে ভয়, আতঙ্ক ও ক্ষোভ নিয়ে অঝোরে কাঁদছে মেয়ে সোহানা (১৪) এবং ছেলে সোহান (১১)। মেয়ে সোহানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও ছেলে সোহান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
নিহত সোহাগের পরিবার সূত্রে জানা যায়, সোহাগের বয়স যখন মাত্র ৭ মাস, তখন বজ্রপাতে মৃত্যু হয় তার বাবা আইউব আলীর। এরপর জীবিকার তাগিদে মা আলেয়া বেগম শিশু সোহাগ ও তার আরও দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে বরগুনা ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি দেন। ওই সময় থেকেই সোহাগ ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার মিটফোর্ডে মেসার্স সোহানা মেটাল নামের একটি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করেই অভিযুক্তদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। চাঁদার টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় একসময় সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধও করে অভিযুক্তরা। এরপর বুধবার বিকালে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে চাঁদার দাবিতে সোহাগকে আটকে রেখে দফায় দফায় চাপ প্রয়োগ করা হয়। এতেও চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সোহাগকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। নিহত সোহাগ তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার জিঞ্জিরা কদমতলী কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন নামক এলাকায় বসবাস করতেন।
নিহত সোহাগের স্ত্রী লাকি বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামীর দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন হত্যাকারীরা। আমার স্বামীর ব্যবসা তাদের সহ্য হচ্ছিল না। তারা প্রতি মাসে দুই লাখ করে টাকা চাচ্ছিল। আমার স্বামী তা দিতে চায়নি। আর এ কারণেই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হতে হয়েছে তাকে। সোহাগের মেয়ে সোহানা বলেন, চাঁদা না দেয়ায় আমার বাবাকে পাথর দিয়ে মেরে হত্যা করেছে বিএনপি’র সন্ত্রাসীরা। আমাদের সাজানো-গোছানো পরিবারটা শেষ করে দিয়েছে।
সোহাগের বোন ফাতেমা বেগম বলেন, আমার ভাই প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছিলেন। প্রতি মাসে তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। এ ছাড়াও তার ব্যবসাটাও নিয়ে নিতে চেয়েছেন অভিযুক্তরা। তবে, আমার ভাই তাদেরকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তারা আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন এবং নির্মমভাবে পাথর মেরে হত্যা করে।
সোহাগের ভাগ্নি বিথি বলেন, মামা আর আমরা ঢাকায় থাকতাম। বাকি সবাই বরগুনায় থাকে। আমার মামা প্রথমে কর্মচারী ছিল। গত পাঁচ বছর ধরে নিজেই ভাঙ্গাড়ি ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক মাস আগে থেকে মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা নেয়া শুরু করে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনসহ বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। বুধবার বিকালে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সোহাগকে আটকে রেখে দফায় দফায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। আমরা তার মৃতদেহ নিয়ে এসে গোপনে দাফন করেছি। কারণ হত্যাকারীরা একটি দলের নেতা। তাদের দলের লোক এখানেও আছে।
এদিকে, এই ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে দায়ের করা মামলা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ নিহত সোহাগের স্বজনদের। মামলার বাদী মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, মামলা দায়েরের সময় আমি যে কপি থানায় দিয়েছি সেটি বাদ দিয়ে সুকৌশলে এজাহার হিসেবে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে অন্য আরেকটি কপিতে। তাতে প্রথম কপিতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৭, ১৮ এবং ১৯ নম্বর আসামির নাম বাদ দিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় এমন অনেককে আসামি করা হয়েছে। তবে, এ অভিযোগের বিষয়ে ঢাকার কোতোয়ালি থানার ওসি’র মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থেকে মনির হোসেন ও আলমগীর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১০। এর আগে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন ও সবশেষ মো. টিটন গাজী নামে আরও এক এজাহারনামীয় আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে দেশ জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। সোহাগের নিজ জেলা বরগুনায় চলছে প্রতিবাদ ও শোক। নিহতের পরিবার ও স্থানীয়রা আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।