
গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র - জনতার ওপর হামলা , হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক সাবেক মন্ত্রী - সংসদ সদস্যসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । তাঁদের অধিকাংশই এখন কারাগারে বন্দী । এসব কারাবন্দীর মধ্যে ১৬২ জন ডিভিশন বা শ্রেণির সুবিধা পেয়েছেন । তাঁরা কারাগারে সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের বই , পত্রিকা ও নামাজ পড়ে , গল্প করে এবং সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটি করে । তবে সাবেক মন্ত্রী , সংসদ সদস্যসহ ডিভিশন না পাওয়া অনেকে বিশেষ বন্দী হিসেবে রয়েছেন ।
দেশে ঢাকায় একটি বিশেষ কারাগার , চৌদ্দটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫ টি জেলা কারাগার রয়েছে । কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় , গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দীদের মধ্যে ৮ জুলাই পর্যন্ত ডিভিশন পেয়েছেন ১৬২ জন । এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী , প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ৩০ জন এবং সংসদ সদস্য ৪৪ জন । বাকি ৮৮ জনের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সচিব , বিচারপতি , পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা , সেনা ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশার বন্দীরা । ডিভিশনপ্রাপ্ত এসব বন্দী রয়েছেন ঢাকা বিশেষ কারাগার , ১১ টি কেন্দ্রীয় ও ১৪ টি জেলা কারাগারে ।
বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক সরকারের লোকজনসহ অনেক হোমরাচোমরা আটক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কারাগারগুলোতে ডিভিশনপ্রাপ্তদের সংখ্যাও অতীতের চেয়ে অনেক বেশি । এরপরও অবশ্য ডিভিশন সুবিধা পাননি— এমন অনেকে রয়ে গেছেন । কারাবিধি অনুযায়ী কারাবন্দীদের দুই ধরনের ডিভিশন দেওয়া হয়ে থাকে ।
বিধিতে বলা হয়েছে , ভালো চরিত্রের অধিকারী , সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষিত ও উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত বন্দী এবং নিষ্ঠুরতা , মারাত্মক অপরাধ , সম্পদ আত্মসাৎসহ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে দণ্ডিত নন — এমন ব্যক্তিরা ডিভিশন -১ এর যোগ্য হবেন । এ ছাড়া বিধির ৬১৭ ( ২ ) ধারায় বলা হয়েছে , সামাজিক মর্যাদা , শিক্ষা ও অভ্যাসের কারণে জীবনযাপনের ধরন উচ্চমানের এমন বন্দীরা ডিভিশন- ২ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন । এসব বন্দীর বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেবেন বন্দীর আইনজীবী ও স্বজনেরা ।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাঁর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও ঢাকা -১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান , বিদ্যুৎ , জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক - ই- ইলাহী এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ও সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গ্রেপ্তার হন । তাঁরা তিনজনই ঢাকা বিশেষ কারাগারে ডিভিশন বন্দী হিসেবে রয়েছেন ।
গত ১৩ আগস্ট মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম গ্রেপ্তার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক । এরপর হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি , সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু , সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান , সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন , সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু , সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান , সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক , সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম , সাবেক ডাক , টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ অন্তত ৩৫ জন সাবেক মন্ত্রী- প্রতিমন্ত্রী - উপমন্ত্রী একে একে গ্রেপ্তার হন । কারাগারে থাকা এসব মন্ত্রীর মধ্যে ৩০ জন বর্তমানে ডিভিশন পাচ্ছেন । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার আসামি ও সাবেক মন্ত্রীদের অনেকে ঢাকা বিশেষ কারাগারে রয়েছেন । আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই কারাগার বিশেষ বন্দীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল । রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন সেখানেই বন্দী রয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সাবেক মন্ত্রী- প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও ৬০ জনের বেশি সাবেক সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, ঢাকা -৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মো . সেলিম, ঢাকা -১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান , দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুসহ বন্দী থাকা ৪৪ জন সাবেক সংসদ সদস্য ডিভিশন পাচ্ছেন । তাঁরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার , বিভাগীয় কেন্দ্রীয় কারাগার ও জেলা কারাগারে বন্দী রয়েছেন ।
কারা সূত্রে জানা যায় , ডিভিশন পাওয়া বন্দীরা কারাবিধি অনুযায়ী খাটসহ একজনের বা দুজনের কক্ষ পেয়েছেন । সেখানে চেয়ার , টেবিল , তোষক , বালিশ , মশারি ও আয়নার ব্যবস্থা আছে । তেল , চিরুনি এবং সংবাদপত্রও দেওয়া হয় । ডিভিশনপ্রাপ্তদের খাবারের মেনুও কিছুটা ভিন্ন । এ আসামিদের ছোটখাটো কাজ করে দেওয়ার জন্য প্রতিটি ফ্লোরে একজন করে সাধারণ বন্দীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । ডিভিশন পাওয়া বন্দীদের পাশাপাশি সেলেই রাখা হচ্ছে । ছোট কক্ষে একজন এবং বড় কক্ষে দুজন করে থাকেন । সকালে প্রায় সবাই খবরের কাগজ পড়েন । এ ছাড়া দিনের অন্য সময়ে কেউ কেউ গল্প - উপন্যাস , জীবনী , ধর্মীয় ও আইনসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়েন । কেউ কেউ নামাজ পড়েন । বয়স্ক বন্দীদের অনেকে সকাল - বিকেল সেলের সামনের ফাঁকা স্থানে কিছু সময় হাঁটাহাঁটিও করেন । ৫ আগস্টের পর গ্রেপ্তার হওয়া বন্দীদের মধ্যে কয়েকজনের ডিভিশন বাতিলও করেছে কারা কর্তৃপক্ষ । আচরণবিধি ভঙ্গ করায় নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের ডিভিশন বাতিল করা হয় । তবে কারারক্ষীদের সঙ্গে এই বিশেষ বন্দীরা কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করছেন না বলেই কারা সূত্র জানিয়েছে ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের কারাবিধি অনুযায়ী যেসব সুবিধা দেওয়া দরকার , সেগুলো দেওয়া হয়েছে । ' কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় , এখনো সাবেক মন্ত্রী , সংসদ সদস্য ও আমলাসহ ২৮ কারাবন্দী ডিভিশন পাননি । তাঁরা কারাগারে রয়েছেন বিশেষ বন্দী হিসেবে ।
এসব বিশেষ বন্দীর মধ্যে আছেন সিরাজগঞ্জ -৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস , সিলেট -১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এম এ লতিফ , কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি , ঢাকা -৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সোলাইমান সেলিম , কুষ্টিয়া -৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ , নোয়াখালী -৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী , সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা , অভিনেত্রী শমী কায়সার প্রমুখ । ডিভিশন না পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক কয়েক নারী সংসদ সদস্যও । এদের মধ্যে আছেন বরিশাল -৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ , সিরাজগঞ্জ -২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী , সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম । তাঁরা সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে থাকছেন ।
সবচেয়ে বেশি ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী ( ৪৬ জন ) রয়েছেন কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে । সংখ্যার হিসাবে তারপরেই রয়েছে ঢাকা বিশেষ কারাগার ( ৪৫ জন ) । এ ছাড়া গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার - ২ - এ ১৫ জন , কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ১২ জন , মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৮ জন , অন্য ৬ টি কেন্দ্রীয় কারাগারে ৯ জন , খুলনা কিশোরগঞ্জ , নোয়াখালী , দিনাজপুর জেলা কারাগারে ১২ জনসহ ১৪ টি জেলা কারাগারে ২৭ জন ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী রয়েছেন ।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ কারাগারে বন্দী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা , রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনেকেই কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন । তবে কারাগারে আচরণবিধি না মানায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দুই - একজনের ডিভিশন বাতিলও করা হয়েছে । ' ডিভিশন না পাওয়া বন্দীদের বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক বলেন , আদালত যেসব বন্দীর বিষয়ে ডিভিশন দেওয়ার আদেশ দেন , কারা কর্তৃপক্ষ সেই বন্দীদের ডিভিশন দেন । কারাবিধি অনুযায়ী তাঁদের ডিভিশন সুবিধা দেওয়া হয় ।