
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে ছাত্রত্ব শেষ হলেও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি তুলেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। তবে প্রশাসন আইনি জটিলতার কারণে ছাত্রত্ব শেষ, এমন কাউকে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবে না- এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমানে ঢাবির প্রায় সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ। এর মধ্যে বেশির ভাগেরই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
কয়েকটি ছাত্রসংগঠন বলছে, ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রসংগঠনগুলো এই সেশনকে ডাকসুতে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাবি শাখার আহবায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং একটি নতুন, সুস্থ সংস্কৃতি গড়তে চেয়েছিল।
ঢাবি শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ২০১৮-১৯-এর নেতৃত্ব উল্লেখযোগ্য ছিল। সঠিক সময়ে নির্বাচন হলে তারা অংশ নিতে পারতেনস্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদের আহবায়ক জামালুদ্দিন মুহাম্মদ খালিদ বলেন, ‘২০১৮-১৯ ব্যাচ ২৪শে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানসহ ক্যাম্পাসের সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ডাকসু নির্বাচন বিলম্বের জন্য প্রশাসন দায়ী। যেহেতু এই ব্যাচের একটি অংশ এখনো শিক্ষার্থী এবং অন্যরা সুযোগ পাচ্ছে, তাই তাদের ডাকসুতে সুযোগ দেওয়া যৌক্তিক।’
ঢাবি শাখা ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘সঠিক সময়ে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা উভয়সংকটে। কিছু শিক্ষার্থীর মাস্টার্সের রেজাল্ট শেষ, কিছু পরীক্ষা ও ফলাফল বাকি।
কিছু ছাত্রসংগঠন বর্তমান ছাত্রত্বকে ভোটাধিকারের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখছে। তারা ২০১৮-১৯ সেশনের যাদের ছাত্রত্ব এখনো রয়েছে, তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলছে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার আহবায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের অনেকেরই ছাত্রত্ব আছে। ছাত্রত্ব থাকার ভিত্তিতে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘বয়সসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে, এম ফিল দেওয়া হয়েছে; তাহলে ১৮-১৯ সেশনকে সুযোগ দিতে সমস্যা কোথায়? নিয়মের ভেতরেই যেন তারা সুযোগ পায়।’
বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সামি আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা বৈধ শিক্ষার্থীরই ভোট দেওয়ার এবং ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার আছে। ১৮-১৯ সেশনের ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষার্থীর মাস্টার্স শেষ, বাকিদের রেজাল্ট পেন্ডিং। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আইনি জটিলতার কারণে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের ডাকসু নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘সব ছাত্রসংগঠন এই সেশনকে নির্বাচনে রাখার দাবি জানিয়েছিল, আমরাও গুরুত্ব দিয়েছিলাম। তবে আইনি পরামর্শ অনুযায়ী যাদের ছাত্রত্ব নেই, তাদের নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করলে পরবর্তী সময়ে আইনি জটিলতার আশঙ্কা থাকে।’
অধ্যাপক রব্বানী আরো উল্লেখ করেন, ‘যাদের ছাত্রত্ব নেই, তাদের যদি নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধে যে কেউ আদালতে গিয়ে রিট করতে পারে। এতে করে নির্বাচন আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
তিনি নিশ্চিত করেন, ‘আইনের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। সে অনুযায়ী আমরা এই সেশনকে রাখতে পারছি না। তবে এই সেশনের যাদের ছাত্রত্ব রয়েছে তারা নির্বাচনে প্রার্থী কিংবা ভোটার হতে পারবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আইনি মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন বরাবর লিখিত মতামতে উল্লেখ করেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সংবিধানের ৪(খ) এবং ১৪(ক) ধারা অনুসারে, যারা মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেছেন, তারা আর ডাকসু বা হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন।
এর অর্থ হলো, ২০১৮-২০১৯ সেশনের যেসব শিক্ষার্থীর মাস্টার্স ডিগ্রির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তারা আসন্ন ডাকসু বা হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার বা প্রার্থী হতে পারবেন না।’
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সংবিধানের বিধান সংশোধন করার ক্ষমতা রাখে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, সিন্ডিকেট ৪(খ) এবং ১৪(ক) ধারা এমনভাবে সংশোধন করতে পারে কি না। এতে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করা শিক্ষার্থীদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এর উত্তর হলো- ‘না’। প্রশাসনিক আইন অনুসারে, সিন্ডিকেট এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়।’
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩-এর ২৪ ধারায় সিন্ডিকেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। উল্লিখিত ৪(খ) এবং ১৪(ক) ধারা সংশোধন করে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের, যারা তাদের ছাত্রজীবন শেষ করেছেন, তাদের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ঘোষণা করা ‘অযৌক্তিক’ হবে। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩-এর ২৪ ধারার পরিধির বাইরে যাবে। এমন কোনো সংশোধনী আদালত কর্তৃক বাতিল বলে গণ্য হবে। কারণ এটি ‘ওয়েডনেসবারি অযৌক্তিকতা’ (Wednesbury unreasonableness) নীতির পরিপন্থী হবে।’
‘উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে, এটি বলা যায় যে ডাকসু সংবিধানের ৪(খ) এবং ১৪(ক) ধারা অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ সেশনের যেসব শিক্ষার্থীর মাস্টার্স ডিগ্রির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তারা আসন্ন ডাকসু বা হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার জন্য আর যোগ্য নন।’