Image description

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। উত্তরা রাজলক্ষীর কাউলাই এলাকা তখন উত্তাল। কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে সমবেত হয়েছে হাজারো মানুষ। ‘মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই’, ‘শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’—এমন স্লোগানে মুখর রাজপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন সাধারণ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, মো. জাহিদ।

কিন্তু রাষ্ট্র সেই প্রতিবাদকে সহ্য করেনি। আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু হলে মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন জাহিদ। মুখের বাঁ পাশে এবং উরুতে গুলি লাগে। রাস্তা রক্তে ভেসে যায়। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই প্রাণ হারান এই তরুণ শ্রমিক।

জাহিদের বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার মাথারপাড়া গ্রামে, সনটিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে। পিতা জিয়াউল হক একজন কৃষক। দুই ভাই-বোনের সংসারে একমাত্র ছেলেটিই ছিল পরিবারের সবচেয়ে বড় ভরসা। স্কুল পেরোনোর পর আর পড়তে পারেননি অভাবের তাড়নায়। ঢাকায় এসে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ নেন। রাজলক্ষী এলাকায় একটি দোকানে কাজ করতেন।

অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন জাহিদ। শর্ট সার্কিট, লোডশেডিং—কোনো জটিলতা তাকে আটকে রাখতে পারত না। কিন্তু তার চোখে ছিল কেবল সার্কিট নয়, ছিল দেশের দিকেও তাকিয়ে থাকা এক সজাগ দৃষ্টি। ফেসবুকে খবর দেখতেন, আন্দোলনের খোঁজ রাখতেন। বলতেন— ‘আমি শ্রমিক, কিন্তু আমি দেশের সন্তান। আমার সন্তান যদি একদিন বলে, ‘বাবা তুমি কিছু করো নাই’, আমি কী জবাব দেবো?’

সেদিন উত্তরা রাজলক্ষীতে পুলিশ গুলি ছুড়লে জাহিদও স্লোগানরত তরুণদের সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে। এক কণ্ঠ চিৎকার করে ওঠে— ‘ভাইটা পড়ছে! ভাইটা পড়ছে!’ সব শেষ। জাহিদ আর কোনোদিন বাড়ি ফিরলেন না।

আজ জাহিদের মা সেই সনটিয়ার ছোট টিনের ঘরে বসে থাকেন চুপচাপ। কথা বলেন না। ঘরের কোণে একটা কাঠের চেয়ার—যেখানে এক সময় জাহিদ বসে বিদ্যুতের কাজ বুঝে নিতেন—সেটাই পড়ে আছে দরজার পাশে। এখন সেই চেয়ারের নাম হয়েছে ‘জাহিদের চেয়ার’। মা প্রতিদিন হাত বুলিয়ে দেন চেয়ারে, যেন জাহিদের মুখে একবার শুনতে পান—‘আম্মু, খাইছো?’

জাহিদের বাবা জিয়াউল হক বলেন, ‘আমার ছেলেটা কোনো অন্যায় করেনি। সে শুধু চাইছিল অন্যায় বন্ধ হোক। ও শহীদ হয়েছে, কিন্তু তার শূন্য চেয়ারে যারা বসবে, তারা যেন ভুলে না যায় কিসের জন্য সে রক্ত দিয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।