Image description
অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ১০ জুলাই । দুটি মামলা চার্জগঠন পর্যায়ে ও অভিযোগ আমলে নিয়েছেন দুটি মামলার । আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আশাবাদ -প্রসিকিউশন ।

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার এখন দৃশ্যমান। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য ১০ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সোমবার এ আদেশ দেন আদালত। এ সময় রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামি পক্ষের আইনজীবী শুনানিতে বলেন, শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি। তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

প্রসিকিউশন জানিয়েছে, ওইদিন (১০ জুলাই) এ মামলার চার্জ গঠন হলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হতে পারে। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে চানখাঁরপুলে ছয় ছাত্র হত্যা মামলার চার্জ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য ১৪ জুলাই দিন ধার্য আছে। একই সঙ্গে আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে পোড়ানো ও রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর তা আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে পোড়ানোর মামলা ১৩ জুলাই এবং আবু সাঈদ হত্যা মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ১০ জুলাই ধার্য আছে।

প্রসিকিউশন জানায়, এই চার মামলার তদন্তে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে এসেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগও আছে। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও রয়েছেন।

শেখ হাসিনার বিচার এখন দৃশ্যমান বলে উল্লেখ করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। তিনি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, জুলাই-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হাসিনাসহ তিনজন এবং চানখাঁরপুলে ছয় ছাত্র হত্যা এই দুটি মামলা চার্জ গঠন পর্যায়ে রয়েছে। আর আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে পোড়ানো ও রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর তা আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, জুলাই মাসের শেষে অথবা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হতে পারে বলে আশা করছি।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গত বছরের জুলাই মাসে আন্দোলন শুরু হয়। সারা দেশে তীব্র গতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। টানা ৩৬ দিনের সেই গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর ধারাবাহিকতায় ওইদিন পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণ-অভ্যুত্থানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় ২৫ হাজারেরও বেশি।

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে গুম-খুন-নির্যাতনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে ৪৩০টি। এখন পর্যন্ত যে ২৭টি মামলা হয়েছে তার মধ্যে ২৩টি বিবিধ মামলা বা মিস কেস। আর চারটি মিস কেস নিয়মিত মামলায় রূপ নিয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। এখনো পলাতক ১৩২ জন। সে হিসাবে এখন পর্যন্ত চারটি মামলায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলাও রয়েছে। বাকি তিনটির একটি রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে পোড়ানোর মামলা। অন্য মামলাটি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ১০ জুলাই : এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচটি অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য ১০ জুলাই তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। তাদের পক্ষে আমির হোসেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। অভিযোগ গঠন বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আজকের শুনানিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের অব্যাহতির আবেদন করেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ।

শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি, অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে : সোমবার শুনানিতে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ। আমির হোসেন বলেন, ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করেছেন। শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেননি। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলায় সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে। আসাদুজ্জামান খানও সুনামের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলক ও কাল্পনিক। শুনানিতে আমির হোসেন আরও বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ বাংলাদেশিকে হত্যা ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছিল। সে সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য এই আইন (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন) করা হয়েছে।

২০২৪ সালে দেশে কোনো যুদ্ধ হয়নি। এমন আন্দোলন আরও হয়েছে। তাই এ আইনে জুলাইয়ের মতো ঘটনার বিচার করা যায় না। শুনানিতে আমির হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেননি। তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনকারীদের লাশ কবর দিতে বাধা, লাশে আগুন দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। যার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। শুনানিতে আমির হোসেন আরও বলেন, রংপুরে আবু সাঈদকে হত্যার যে অভিযোগ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তাও সত্য নয়। আবু সাঈদ হত্যায় তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। এমনকি তার পরিবারকে ঢাকায় এনে শেখ হাসিনা সাহায্য করেছেন। শুনানিতে আমির হোসেন বলেন, ‘রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনা শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ঘটেছে। এসব অভিযোগও ভিত্তিহীন।’ এসব যুক্তির ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের অব্যাহতি চান রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

মামলার অপর আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গ্রেফতার আছেন। তাকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার আইনজীবী জানান, অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানিতে তিনি অংশ নেবেন না। শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য তারিখ ধার্য করেন।

এছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-খুন ও নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলা হয়েছে। আগামী ২৪ আগস্ট এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন নির্ধারিত রয়েছে। শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগে করা মামলায়ও। এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা আগামী ১২ আগস্ট।