
মো. জাবেদ ইকবাল লিয়ন। ৪ঠা আগস্টে রাজধানীর কাওরান বাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিরত জাবেদের কথা ছিল ১০ই আগস্টে পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্ত্রীকে নিজ বাড়িতে তুলবেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রস্তুতিও সম্পন্ন ছিল। কিন্তু ৪ঠা আগস্টে পুলিশের গুলিতে আহত জাবেদের সব এখন কেবলই অতীত। হয়নি কোনো অনুষ্ঠান। চিকিৎসার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল)-এ চিকিৎসাধীন জাবেদ মানবজমিনকে বলেন, পিজি হাসপাতালের মেশিন নষ্ট থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। এতে বাড়তি খরচ নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনই পরে রূপ নিয়েছিল সরকার পতনের আন্দোলনে। জুলাই-আগস্ট মাসে ‘ছাত্র-জনতার’ সেই তীব্র আন্দোলনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা জুলাই যোদ্ধারা এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। অনেকে আবার চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। হাসপাতাল সূত্রগুলো বলছে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আহত হয়ে রাজধানীর ৪ হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৬৯ ছাত্র-জনতা। এরমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৩৬ জন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)-এ ১১ জন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২ জন এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (ঢাকা) বা সিএমএইচ-এ ২০ জনের মতো চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সরজমিন আহত ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ সঙ্গে কথা বলে মানবজমিন।
চিকিৎসার অগ্রগতি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কেউ কেউ বলেন, অস্ত্রোপচারের পরে পুঁজ পড়লেও নিজের ড্রেসিং নিজে করতে হচ্ছে, ডাক্তারদের দেখা নেই। জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রথম ধাপের টাকা ব্যতীত আর কোনো আর্থিক সহায়তা না পাওয়া, হাসপাতালের মেশিন নষ্ট থাকায় চিকিৎসায় বাড়তি ব্যয় নিয়ে নানা অভিযোগ করেন তারা। আবার বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষে বিদেশে যাওয়ার জন্য এখনো মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় আছেন অনেকে। এ ছাড়াও চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিন ইনচার্জ আফরোজা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, গত বছরের ৮ই আগস্ট থেকে ১৮৭ জন জুলাইযোদ্ধা চিকিৎসা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে। অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ৩৬ জন এখনো চিকিৎসাধীন আছে। এখানে চিকিৎসাধীন জাবেদ ইকবাল মানবজমিনকে বলেন, আমি গত ২৬শে জুন ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে ‘সিটি পেরিফেরাল এনজিওগ্রাফি’ এবং ‘কনট্রাস্ট এমিডল’ করাই। এ দু’টি পরীক্ষার খরচ ১৯ হাজার টাকা। আমাকে ছাড় দিয়ে কিছু টাকা ছাড় দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমি বিএমইউ হাসপাতালে এ পরীক্ষাগুলো করতে চাইলে তারা জানায় হাসপাতালের মেশিন নষ্ট। তাই আমাকে বাড়তি টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে করতে হচ্ছে। আমি এটা ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ জানালে তারা আমাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তিনি বলেন, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ১ বছর বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব। আমার চাকরিটাও প্রায় যায়-যায় অবস্থায় আছে। আমাকে জুলাই মাস পর্যন্ত ১ বছরের ছুটি দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমি যেহেতু সিনিয়র অফিসার হিসেবে অডিট সেকশনে ছিলাম, শারীরিক অবস্থার কারণে আমার পক্ষে বিভিন্ন ব্রাঞ্চে গিয়ে অডিট করাটাও সম্ভব নয়। আমি চাকরি ও চিকিৎসা খরচ নিয়ে বেশ চিন্তিত।
যাত্রাবাড়িতে গত ১৯শে জুলাই পুলিশের গুলিতে আহত হন নাজমুল ইসলাম। পোস্তগোলা সেনানিবাসের পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন তিনি। সেখানকার সৈনিকেরা নিজ উদ্যোগে আর্মির গাড়ি দিয়ে ২১শে জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান নাজমুলকে। চিকিৎসা শেষে সেনানিবাসেই আশ্রয় দেয়া হয় তাকে। কিন্তু ৫ই আগস্ট নাজমুলের মামাতো ভাই যাত্রাবাড়ি থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হলে, তাকে দেখতে সেনানিবাস থেকেই ছুটে যান নাজমুল। তখন আবার পুলিশের বুলেটবিদ্ধ হন। এরপর থেকে হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত বিএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। দুই দফা হয় পায়ের অস্ত্রোপচার। গত ২৯শে জুন দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচারের পর পা থেকে অনবরত পুঁজ পড়ছে তার। অভিযোগ করে তিনি বলেন অপারেশনের পর থেকে ডাক্তারদের আর দেখা নাই। নিজে নিজেই পুঁজ পরিষ্কার করতে হচ্ছে আমার। ডিউটি ডাক্তারদের বলার পরেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেন না। এ ছাড়াও আমার গোপনাঙ্গে ছিটা গুলি থাকলেও ডাক্তাররা তা বের করতে পারছেন না। আমাকে বিদেশ রেফার করলেও কবে নাগাদ বিদেশ যাওয়া হবে তার কোনো খবর নাই।
গাজীপুর নাওজোড় কাউন্সিলর অফিসের সামনে গত ৪ঠা আগস্ট পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন টাঙ্গাইলের মধুপুরের বাসিন্দা মো. সোহানুর রহমান। অসুস্থ শরীর নিয়ে ৫ই আগস্ট আবার আন্দোলনে গিয়ে ফের আহত হন তিনি। এরপর সোহানুর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে গত ৬ মাস ধরে বিএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সোহানুর মানবজমিনকে বলেন, রেডিয়াল নার্ভ সংক্রান্ত কয়েকটি পরীক্ষার জন্য হাসপাতাল থেকে লিখে দিয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের এমআরআই করার মেশিনসহ কয়েকটি মেশিন নষ্ট থাকায় বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করাতে প্রায় ২২ হাজার টাকা লাগবে। কিন্তু সে টাকা আমার নাই। কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘ ৯ মাসের চিকিৎসা শেষে প্রায় নিঃস্ব অবস্থা আমার। তিনি বলেন, আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় এখানকার মেশিন ঠিক হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ব্যথায় পা নাড়াতে পারছি না। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে শুধু প্রথম ধাপের টাকা ছাড়া আর কোনো সহায়তাই পাইনি। গুরতর অসুস্থ বিবেচনায় জুলাই ফাউন্ডেশন আমাদের দ্বিতীয় ধাপের টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো খবর নাই তাদের।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের স্বাস্থ্য প্রতিনিধি নাবিলা নাদিয়া মানবজমিনকে বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে ৭০০ জন বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে। সুস্থ হয়ে অনেকে বাড়ি ফিরেছেন। তাছাড়া ঈদুল আজহার পরে ৫৪ জনকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এখনো হাসপাতালটিতে বোবা আহত সেলিম মিয়া ও ফয়েজ নামে ২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। চোখে গুলি লাগায় তাদের চোখে প্রতিনিয়ত সিলিকন ওয়েলসহ বিভিন্ন সেবা দিতে হচ্ছে।
রাজধানীর সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবুল মিয়া মানবজমিনকে বলেন, তিনি ২০শে জুলাই গোলাপবাগে পুলিশের গুলিতে আহত হন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে সিএমএইচএ ভর্তি আছেন। চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও কবে নাগাদ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন তা জানেন না তিনি। তিনি জানান এখন তার সঙ্গে ২০ জনের মতো জুলাইযোদ্ধা চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালটিতে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)-এ জরুরি বিভাগের ৪র্থ তলার (এ) ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নাদিম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ১৯শে জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত ২৮শে অক্টোবর থেকে নিটোরে ভর্তি আছেন। এ পর্যন্ত ৭ দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন তিনি। কিন্তু শারীরিক অগ্রগতি না হওয়ায় তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য রেফার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রয়েছে তার। এখন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে যাদের বিদেশ রেফার করেছে সরকার যেন দ্রুত তাদের বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
গত ৫ই আগস্টে গাজীপুরের মাওনাতে গুলিবিদ্ধ হন শামীম হোসেন। গার্মেন্টসে চাকরিরত জানান, ৪ মাস ধরে নিটোরে ভর্তি তিনি। বাম হাঁটুর উপরে বুলেট লাগে তার। ৪ দফা অপারেশন শেষে হাসপাতাল থেকে তাকে বিদেশে রেফার করেছে। কিন্তু কবে নাগাদ বিদেশ যাবেন তা জানেন না তিনি।