
সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উদ্যোগে গত এপ্রিলে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্স কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়। এটি প্রকাশের পরই অংশীজনদের পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠে।
সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উদ্যোগে গত এপ্রিলে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্স কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়। এটি প্রকাশের পরই অংশীজনদের পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠে। এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে টেলিকম খাতের স্থানীয় উদ্যোগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তারা। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, গ্রাহকের ভয়েস কল ও ডাটার খরচ কমানোর জন্যই নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। অতীতে বহুস্তরের লাইসেন্স কাঠামোর সুবিধা নিয়ে যারা লাভবান হয়েছেন তারাই মূলত এর বিরোধিতা করছেন।
দেশকে একটি আধুনিক, প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই ডিজিটাল টেলিযোগাযোগ খাতে রূপান্তরের লক্ষ্যে নতুন টেলিকম নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রেজিম রিফর্ম পলিসি-২০২৫-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে বলে সরকারের দাবি। জটিল ও পুরনো লাইসেন্সিং কাঠামো সরলীকরণ; উদ্ভাবন, বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা; সাশ্রয়ী মূল্যে ও গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত; টেকসই ও নিরাপদ ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলা এর মূল্য উদ্দেশ্য।
খসড়ায় তাই টেলিকম খাতের লাইসেন্স কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে সেলুলার মোবাইল সার্ভিস ও ফিক্সড টেলিকম সার্ভিসের জন্য পৃথক একটি অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার (এএনএসপি) লাইসেন্স দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এএনএসপিগুলো গ্রাহক পর্যায়েও সেবা দেয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে অবকাঠামো ও ট্রান্সমিশন সেবা যেমন ফাইবার, টাওয়ার ও নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন পরিচালনার জন্য ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (এনআইসিএসপি) লাইসেন্স দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক ভয়েস, ইন্টারনেট ও ডাটা সংযোগের জন্য নিতে হবে ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (আইসিএসপি) লাইসেন্স। স্যাটেলাইট, নন-টিরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্কস (এনটিএন) ও হাই-অলটিটিউড প্লাটফর্মস (এইচএপি) ভিত্তিক সেবার জন্য নন-টিরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্কস অ্যান্ড সার্ভিস প্রোভাইডার (এনটিএনএসপি) লাইসেন্স নিতে হবে। তাছাড়া এসএমএস এগ্রিগেটর, ওটিটি ইত্যাদি সেবার জন্য টেলিকম এনাবলড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে। নতুন এ পলিসি কার্যকর হওয়ার পর আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স, এনআইএক্স, এমএনপি লাইসেন্সগুলো ধীরে ধীরে বাতিল হয়ে যাবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করতে হলে ২০২৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নতুন কাঠামো অনুসারে লাইসেন্স নিতে হবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ পলিসি বাস্তবায়ন হলে দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানকারী ২৩টি আইজিডব্লিউ এবং আন্তঃঅপারেটর সেবাদানকারী ২৪টি আইসিএক্স প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ আইসিএক্স অপারেটররা তাদের আয়ের অর্ধেকই সরকারকে দেয়। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকার রাজস্বও পায়। নতুন পলিসি অনুসারে এটি স্থানান্তরিত হয়ে চলে যাবে মোবাইল অপারেটরদের কাছে। এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাবে স্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাও। কর্মহীন হয়ে পড়বে কয়েক লাখ লোক। তাছাড়া টেলিকম খাতে ঘন ঘন নীতিমালা পরিবর্তন এ খাতের জন্য সহায়ক নয় বলেও মনে করছেন তারা।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএসপিদের জন্য প্রথম নীতিমালা করা হয় ২০২১ সালে, যেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে ২০২২ সালে। সেই নীতিমালার আলোকে আমরা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও কৌশল গুছিয়ে নিয়েছি। এখন ২০২৫ সালে এসে আবার আরেকটি নীতিমালার কথা বলা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি সামনের বছর একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। তখন যে আরেকটি নীতিমালা করা হবে না, তা কে বলতে পারে?’

টেলিযোগাযোগ খাতের ব্যবসা উৎপাদন খাতের মতো নয় মন্তব্য করে আইএসপিএবি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। ফলে ঘন ঘন নীতিমালার পরিবর্তন আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। আমরা যারা ফিক্সড টেলিকম অপারেটর রয়েছি তারা সবাই স্থানীয় উদ্যোক্তা এবং এর ৯৫ শতাংশই আবার ছোট উদ্যোক্তা। লাস্ট মাইলটা কোনো কোনো জায়গায় বলা হচ্ছে যে টেলিকম অপারেটর দেবে না, আবার কোনো জায়গায় বলা হচ্ছে সেলুলার অপারেটর আইটিও স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করবে। আজকে যে আইটিও স্ট্যান্ডার্ড আছে সেটি আগামী বছর নাও থাকতে পারে। তার মানে আমার বিজনেস ডোমেইন তার হাতে চলে যেতে পারে। এখানে আমরা কোনো উন্মুক্ত নীতিমালা চাইছি না। বরং সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে যে লাস্ট মাইল ফাইবার অপটিকসে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড অপারেটর দেবে এবং লাস্ট মাইল ওয়্যারলেসে টেলিকম অপারেটর দেবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এনটিটিএন অপারেটরদের নতুন নীতিমালায় এনআইসিএসপি বলা হচ্ছে। তাদের নামে-বেনামে ফিক্সড টেলিকম অপারেটরের লাইসেন্স রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে ফিক্সড টেলিকম অপারেটর চাইলে লাস্ট মাইলে চলে যেতে পারবে। যেহেতু তাদের নামে-বেনামে অন্যান্য লাইসেন্স রয়েছে, সেহেতু তাকে এটা বলার মানে হলো যে লাস্ট মাইলে ফাইবার অপটিকস আবার চলে যাবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো সুরক্ষা থাকছে না।’
টেলিকম পলিসির খসড়া প্রকাশ হওয়ার পরই এ বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানায় অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটরস অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির মতে, এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ খাতের সহস্রাধিক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যমান আইএলডিটিএস নীতিমালার আওতায় গড়ে ওঠা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত টিকে থাকতে পারবে না। প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ মূলত বিদেশী বড় কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে। যার ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে বিদেশী কোম্পানিগুলোর নির্ভরতা কমানোর আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
স্থানীয় একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের একটি নীতিমালা রাজনৈতিক সরকারের সময়ে করাই ভালো। তাছাড়া এটি করার আগে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, এ ধরনের কোনো মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোই তুলনামূলক বেশি সুবিধা পাবে।’
প্রস্তাবিত এ পলিসিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী মালিকানার সীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এএনএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ বিদেশী মালিকানা থাকতে পারবে। এনআইসিএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ বিদেশী মালিকানার সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে তা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আইসিএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিদেশী মালিকানার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ। নতুন এ পলিসিতে মোবাইল ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমভিএনও) চালুর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি এসএমপি (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার) প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে সেজন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ব্যয় কমানো ও সেবার পরিধি বাড়াতে অবকাঠামো ভাগাভাগি করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। এ পলিসি অনুসারে সাইবার নিরাপত্তা আইন, জাতীয় তথ্য আইন ও ডাটা সুরক্ষা নীতিমালা মেনে চলতে হবে। আইনি অনুমোদনের ভিত্তিতে আড়িপাতার সুযোগ রাখার কথাও বলা হয়েছে এতে। শুধু শহরে সেবা চালুর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে গ্রাম ও অনুন্নত এলাকায়ও সেবা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ভর্তুকি, ছাড় ও বিশেষ তহবিলের সুবিধা পাওয়া যাবে।
পর্যায়ক্রমে নতুন এ পলিসি বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। প্রথমে এটি কার্যকর করার পর প্রয়োজনীয় বিধিমালা সংশোধন করা হবে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন লাইসেন্স ইস্যু করা শুরু হবে। সবশেষে ২০২৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পুরনো সব লাইসেন্স বাতিল হয়ে নতুন লাইসেন্স কার্যকর হবে।
নীতিমালাটি প্রথমে এ বছরের এপ্রিলে প্রকাশ করা হয়। এরপর অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে এতে আরো পরিবর্তন করা হয়েছে। শিগগিরই সরকারের পক্ষ থেকে একটি চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করার কথা রয়েছে। তাছাড়া এটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে আরো পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। তবে খসড়া নীতিমালায় বেশকিছু গুরুতর সমস্যা থাকায় এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে একতরফাভাবে এটি বাস্তবায়ন না করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের বিষয়ে মতামত দিচ্ছে এটিকে স্বাগত জানাই। তবে দলগুলোর নীতিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছিল কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মতামত দেননি। সম্ভবত কোনো গোষ্ঠী প্রভাবিত করে বিএনপি মহাসচিবকে দিয়ে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কম। বিনিয়োগে সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে এফডিআই প্রবাহে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে বিদেশীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন যে সবকিছু বিদেশীদের দিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এখানে প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কোনো পক্ষই সঠিক না, বরং আমরা একটি মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছি।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমরা বিদেশী বিনিয়োগ উন্মুক্ত করার পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরও সুরক্ষা দিতে চাইছি। আইটিও এবং জিএসএমএ ২০১৪-১৫ সালের দিকে স্টাডি করে বলেছিল যে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বহুস্তর লাইসেন্স কাঠামো রয়েছে, সেটি এ খাতের বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ও ভয়েস কলের দাম কমানো যাচ্ছে না, কারণ লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় স্তর রয়েছে। এ স্তরগুলো তেমন কোনো মূল্য সংযোজন না করে বাজার থেকে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে ভয়েস ও ডাটা কলের দাম বেশি হচ্ছে।’
সারা বিশ্বে একটি প্রতিষ্ঠানকে সবকিছু করতে দেয়া হলেও মনোপলি হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় বাংলাদেশে এ ধরনের কিছু করা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, ‘পলিসিতে আমরা বলেছি যে যারা সেলুলার সেবা দেবে তারা এনটিটিএন সেবা দিতে পারবে না। এনটিটিএন সেবা দিতে হলে নতুন প্রতিষ্ঠান লাগবে এবং নতুনভাবে শনাক্তকৃত এনটিএন লাগবে, এটি পলিসিতে বলা আছে। এসএমইদের ক্ষেত্রে আমরা চাইছি যে লাইসেন্স তুলে দিতে, অর্থাৎ স্থানীয় আইএসপি যারা তাদের কোনো লাইসেন্স লাগবে না। জাতীয় পর্যায়ে আইএসপি ব্যবসা করতে হলে তখন লাইসেন্স লাগবে। কিন্তু তারা এটি মানতে চায় না, কারণ ব্যাংক ঋণের সঙ্গে লাইসেন্সের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা তাদের বলেছি যে একটা লাইট টাচ লাইসেন্স দেয়া হবে যেটিতে টাকা কম লাগবে।’
আইএসপিগুলোকে এসএমইবান্ধব করার জন্যই এটি করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার এ বিশেষ সহকারী আরো বলেন, ‘বাকি যেসব ব্যবসায়ী রয়েছেন তারা বিগত সময়ে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কয়েকশ কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন, তাদেরকে আমরা নতুন লাইসেন্স রেজিমে চাই না। তাদের লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হবে না, যে সময় পর্যন্ত তারা লাইসেন্স পেয়েছিলেন সেটি শেষ হলে তখন তাদেরকে নতুন বিনিয়োগ ও লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করতে হবে। বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে যে বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে, সেখানে অনেক ভুল ব্যাখ্যা আছে। কয়েকদিনের মধ্যে আমরা পলিসির সর্বশেষ হালনাগাদ প্রকাশ করব, তখন বিএনপি চাইলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মতামত দিতে পারে। অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে এরই মধ্যে পলিসির খসড়ায় বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
টেলিকম খাতের খসড়া নীতিমালা নিয়ে করা জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘টেলিকম খাতের পলিসি নির্ধারণে সরকার তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গ্রামীণ জনগণের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা টেলিকম খাতের টেকসই উন্নয়নে বাধা হতে পারে।’
খসড়া নীতিমালাটি বিশ্লেষণ করে কিছু গুরুতর সমস্যা পাওয়া গেছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘টেলিকম খাতে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নে বাধা হতে পারে এ নীতিমালা। এটা ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাই, এ গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা যেন পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হয়।’
খসড়া নীতিমালার সম্ভাব্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের দিক তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একাধিক সেবা খাতে মালিকানা রাখার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বড় মোবাইল অপারেটররা একাধিক খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়বে।’
এসএমই আর্থিক সংকটে পড়বে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ডি-রেগুলেশনের (নিয়ন্ত্রণ শিথিল) পর এসএমই, বিশেষ করে স্থানীয় আইএসপি বা ছোট টেলিকম অপারেটরদের সম্পদ ও দায়বদ্ধতা নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। বিদেশী মালিকানার সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে, যা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং এ খাতের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে। এছাড়া ক্রস-ওনারশিপের (যৌথ মালিকানা) ফাঁকফোকরে বড় কোম্পানিগুলো আরো বাজার দখল করে নিতে পারে। এ ধরনের জাতীয় পর্যায়ের টেলিকম নীতি প্রণয়নে অবশ্যই সতর্কতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।’
নীতিতে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড বা নতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে নীতিতে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, যা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এন্টারপ্রাইজ সার্ভিসের সীমা অস্পষ্ট। মোবাইল অপারেটরদের ফাইবারভিত্তিক ব্যবসা সংযোগ সেবার সীমাবদ্ধতা কোথায়, তা নীতিমালায় স্পষ্ট নয়। ফলে বিবাদ ও অসাম্য তৈরি হতে পারে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সবার জন্য উপকার বয়ে আনে এমন নীতিই গ্রহণযোগ্য। ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন এবং জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারেই আমরা কাজ করে যাব।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আমরা আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার চাই। বিএনপি চায়, টেকনোলজি সামনের দিকে যাবে, কিন্তু তার সুফলটা যেন জনগণ পায়। এখানে বড় মোবাইল অপারেটররা বিরাট সুবিধা পাবে। আর যারা বাংলাদেশের ভেতরে বড় রকমের বিনিয়োগ করতে পারবে, তারা সুবিধা পাবে। সুবিধার লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ মানুষ যাতে সুফলটা পায়। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি, প্রস্তাবিত নীতিমালায় তা অনুপস্থিত। আমরা এমন নীতিমালা করব, যে নীতিমালার সুফল দেশের মানুষ পায়।’
এ নীতিমালা প্রণয়নে সরকার কারো মতামত নেয়নি বলেও মন্তব্য করেন মঈন খান।