
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সেই অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন নানান শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে কারফিউ, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, গণগ্রেপ্তার—সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলন দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
সরকারবিরোধী এই গণআন্দোলনের নেতৃত্ব গঠিত হয়েছিল একাধিক স্তরে। প্রথম সারির সমন্বয়কারীরা গ্রেপ্তার হলেও আন্দোলনের গতি থেমে থাকেনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির সংগঠকরাই নীতিনির্ধারণ, মাঠ সমন্বয় ও বার্তাবাহক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আন্দোলনের নীতিনির্ধারণে যারা সামনে ছিলেন, তাদের একজন আলী আহসান জুনায়েদ। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক।
‘১৯ তারিখ কারফিউ জারি হওয়া সত্ত্বেও ফজরের নামাজের ঘণ্টাখানেক পরে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ। কারফিউ কেউ মানছে না। সারাদিনব্যাপী স্লোগান চলছিল। লোকজনের সাহস ছিল অন্য লেভেলের। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড যখন ছোঁড়া হচ্ছিল, তখন তারা বলছিল—তারা ক্যাচ ধরবে! আশ্চর্য ব্যাপার। সেদিন বিকেলে হেলিকপ্টার থেকে এবং র্যাব-পুলিশের গাড়ি থেকে সরাসরি গুলি হয়—তিন জায়গা থেকে। আমার চোখের সামনে স্পটেই ৩০ জনের মৃত্যু।’
নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া আলী আহসান জুনায়েদের পিতা এএমএম মুসা এবং মাতা তাসলিমা আক্তার। শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়া করার দিন ৫ আগস্ট রাতভর তারা ছিলেন একত্রে—আলোচনায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, আসিফ মাহমুদ, ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সভাপতি সাদিক কায়েমসহ অনেকে। সেদিন রাতেই তৈরি হয় অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপরিচালনার রূপরেখা।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, নেতৃত্ব, ভবিষ্যৎ ও ব্যক্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হন আলী আহসান জুনায়েদ।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলেছে। সে আন্দোলনে আপনি সামনের সারিতে ছিলেন। জুলাইয়ের প্রত্যেক মুহূর্ত স্মরণীয়, কিন্তু তার মধ্যে কোন বিশেষ ঘটনাটি আপনার সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়?
আলী আহসান জুনায়েদ: অনেকগুলো মুহূর্ত মাথায় আসে। যে দৃশ্যগুলো সম্ভবত সবার মাথায় আসে। যেমন ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মিছিল। মিছিলটা একটা নতুন টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ১৫ জুলাই আমাদের বোনেদের যে রক্তাক্ত চেহারা। সেটা নিয়ে আমরা সবাই ক্ষুব্ধ হলাম। পরের দিন ১৬ জুলাই ক্ষুব্ধ হয়ে সব শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে জড়ো হল। সেদিন আবু সাঈদের শাহাদাৎ প্রত্যেককে নাড়া দিয়েছিল। আমি প্রতিদিনই আন্দোলনের মাঠে ছিলাম। আমার নিজের ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকার দুটো দিন বেশি স্মরণ হয়। ১৯ জুলাই আমি চিটাগাং রোডে ছিলাম। যাত্রাবাড়ীর স্পটে। ১৯ তারিখ কারফিউ জারি হওয়া সত্ত্বেও ফজরের নামাজের ঘণ্টাখানেক পরে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ। কারফিউ কেউ মানছে না। সারাদিনব্যাপী স্লোগান চলছিল। লোকজনের সাহস ছিল অন্য লেভেলের। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড যখন ছোঁড়া হচ্ছিল, তখন তারা বলছিল—তারা ক্যাচ ধরবে! আশ্চর্য ব্যাপার। সেদিন বিকেলে হেলিকপ্টার থেকে এবং র্যাব-পুলিশের গাড়ি থেকে সরাসরি গুলি হয়—তিন জায়গা থেকে। আমার চোখের সামনে স্পটেই ৩০ জনের মৃত্যু। উপরে হেলিকপ্টার ঘুরছিল। মা হাসপাতালের ওখানে পুলিশের অফিস ছিল। সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রথমে দুজন শহীদ হয়। তখন লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপরে ওই পুলিশদেরকে উদ্ধার করার জন্য হেলিকপ্টার আসে। এই হেলিকপ্টার ঘুরতে ঘুরতে গুলি করছিল। আর সামনে থেকে পুলিশ, র্যাব গুলি করছিল। জাস্ট জায়গার মধ্যেই ম্যাসাকার। কী করবে, কিছু বুঝতে পারছিল না সবাই। এই গুলির মধ্যেই লোকজন সামনে যাচ্ছিল। সেদিন আমি এক স্কুল শিক্ষকের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটু পরেই ছাত্রলীগ আর পুলিশ এসে বাসায় বাসায় হানা দেয়—কেউ আছে কিনা। কোনো বিল্ডিংয়ের দরজা খুলেনি।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিন ঘণ্টা টানা গুলিবর্ষণের পরে লোকজন আবার নামছে। তখন মনে হচ্ছিল—এদেরকে আর কেউ থামাতে পারবে না।
আন্দোলনের জন্য কোন দিনটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে আপনি মনে করেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ প্রোগ্রামটা সফল হওয়া। এই কর্মসূচির আগে একটা স্থিমিত অবস্থা চলে আসছিল। আর সারা বিশ্বে আন্দোলনটা ছড়িয়ে গিয়েছিল ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার মধ্য দিয়ে। কিছু দুর্বৃত্ত বাদে সবাই তাদের ফেসবুক প্রোফাইলে লাল পিকচার দিয়েছিল। এটার মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে সবার মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি হয়ে যায়।
এরপরেই ঐতিহাসিক এক দফা ঘোষণা করা হয় ৩ আগস্ট। এক দফা ঘোষণার সাথেই অসহযোগ আন্দোলন ছিল। প্রত্যেকটা কর্মসূচিতে সমন্বয়কদের সাথে আলাপ চলছিল। সাদিক কায়েম-এর সাথে নিয়মিত আলাপ হচ্ছিল। এস. এম. ফরহাদ আর মাহফুজ আলম-এর সাথেও আলাপ হচ্ছিল। ওরা আবার নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ-এর সাথে আলাপ করছিল। আমরা নিজেরাও আলাপ করছিলাম। প্রতিরাতেই এ ধরনের আলোচনা চলছিল। আর সকাল হলেই মাঠে নেমেছি।
সর্বশেষ ৪ আগস্ট, যখন ৬ আগস্টের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, আমি তাদেরকে ফোন দিয়ে বলি, ‘করছো কী? তোমরা তো সবাইকে মেরে ফেলবা। কর্মসূচি তো এতদিন পরে দেওয়ার সুযোগ নেই।’
সেদিন সাদিক কায়েম, শরফুদ্দিন ভাই আর আসিফ মাহমুদকে ফোন দিই। তারা বলছে ৫ তারিখে শ্রমিক আর নারী সমাবেশ। আমি বললাম, এই কর্মসূচির মানে কী? কে বলেছে তোমাদের এই কর্মসূচি দিতে? কারণ এখন সবাই এক হয়ে আছে। শ্রমিক আলাদা, নারী আলাদা ুএই বুদ্ধি কে দিয়েছে? ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি।
পরে রাতেই ঘোষণা আসে যে কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনা হয়। এই সময়টা খুব কঠিন ছিল। নিয়মিত ফোন দিচ্ছিলাম। বেশ বকাঝকা করেছি সবাইকেই।
এর আগে ৩ তারিখ সারা রাত আমরা জাতীয় সরকার নিয়ে আলাপ করেছি। সেদিন জাতীয় সরকারের একটা রূপরেখা আমরা তৈরি করছিলাম। সেটা নিয়ে আসিফ একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল ছাত্ররা মূল। আমি বললাম ‘মূল’ এবং ‘একমাত্র’—এই কথা বলা যাবে না। ‘অন্যতম’ বলতে হবে। কারণ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে আছে। এটা নিয়ে রাতভর আলোচনা হয়। মাহফুজ আলমের সাথে আমার অনেক কথা হয়। আমার ব্যাসিক যোগাযোগটা ছিল মাহফুজের সাথে স্পেশালি। আর সাদিক কায়েম এবং ফরহাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আসিফের সাথে শেষ দিকে যোগাযোগ বেশি হয়েছে। হাসনাতের সাথেও একটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সেন্ট্রাল ফিগার হিসেবে কাজ করছে সাদিক। যখন জাতীয় সরকারসহ টেকনিক্যাল ইস্যুগুলো আসে তখন মাহফুজের সাথে ইন-ডেপথ আলোচনায় যাই।
৫ আগস্ট সকালে আমি বের হই। আগের দিন আমার পরিচিত সবার সাথে কথা হয়—সবাই যেন আসে। প্রত্যেকটা রোডে ফেসবুক এবং টেলিগ্রাম গ্রুপ হয়েছে। নিয়মিত আপডেট করা হতো।
সেদিন সকালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ছিল। আমরা ৭-৮ জন ছিলাম। বের হয়ে হাঁটছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে দেখি কোনো লোকজন নেই। চিটাগং রোড থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে আসছিলাম। ঘুরে ঘুরে আসতে হয়েছে। মেইন রোড দিয়ে আসতে পারছিলাম না। যেখানে লোক পাব, সেখানে তাদের নিয়ে মেইন রোডে উঠতে হবে। সবাইকে ফোন দিচ্ছিলাম।
১১টার দিকে সাদ্দাম মার্কেটের দিকে এসে দেখি প্রায় ৪০০ মেয়ে এবং হাজারখানেক ছেলে। এরা শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আগের রাতে বেসিক্যালি যাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে তাদের অনেকেই আসছে।
সাড়ে এগারোটার দিকে রায়েরবাগ, শনির আখড়া—লাখ লাখ মানুষ। আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই নেমে পড়ছে।
সেসময় যেটা দেখলাম—বিস্ময়কর। এক সারি লোকজন সামনে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারের কাছে গুলি চলছে। গুলিবিদ্ধ লোকেরা পেছনে আসছে, আরেক সারি যাচ্ছে, গুলি খেয়ে পেছনে আসছে, আবার আরেক সারি সামনে যাচ্ছে। কেউ সরে যাচ্ছে না। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
অনেকগুলো মানুষ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজলা ফুটওভার ব্রিজের ওখানে অনাবিল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সবগুলো স্নাইপার শট। কারণ আমরা দেখেছি মাঝখানে একজন এসে গুলি খাচ্ছে। বিল্ডিং থেকে স্নাইপার শট হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মেয়ে মাথায় গুলি খেয়েছে। সবাই কান্নাকাটি করছে, কিন্তু লোকজন কেউ সরছে না। বারবার সামনে যায়। এক অদ্ভুত দৃশ্য। এটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
৫ আগস্ট যখন আমরা শুনছিলাম আর্মি চিফ ভাষণ দেবেন, তখন আমি হ্যান্ড মাইকে বলছিলাম, ‘কেউ যাবেন না। এখনো কিছু হয়নি। আর সামরিক শাসন মেনে নেওয়া যাবে না।’ সবাই সিজদা দেওয়া শুরু করে তখন। পরে তিনটায় যখন ঘোষণা আসে শেখ হাসিনা পালিয়েছে। সবাই খুশি। অনেক জায়গায় এরকম হয়েছে।
বাসস : ৬ আগস্টের কর্মসূচি ৫ তারিখে না আনলে কী হতো বলে আপনি মনে করেন?
আলী আহসান জুনায়েদ : ৬ আগস্ট হলে আন্দোলন ব্যাপক ব্যাকল্যাশ খেত। কারণ ৩ তারিখের পরে আন্দোলনটা পিকে উঠে গেছে। আর ৪ তারিখে যে পরিমাণ লোকজন ছিল, তাদের সংকল্প ছিল গণভবন ঘেরাও করা, হাসিনার পতন যে কোনোভাবে নিশ্চিত করা। যত ডিলে হতো, মোমেন্টাম লস হতো।
আন্দোলনের সব লিডারশিপ ট্রেস হয়ে গেছিল। ২ আগস্ট শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম ভাইকে আমাদের ফাইল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়—আমাদের চেনে কিনা। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
তাই আন্দোলন ডিলে হলে আমাদের জীবন হুমকিতে পড়তো। তাই ৬ আগস্টের কর্মসূচি এগিয়ে আনার কারণে শেখ হাসিনা পরিকল্পনা করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
আন্দোলনের কোন সময়টাতে আপনি বুঝেছিলেন শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত?
আলী আহসান জুনায়েদ: ১৪ই জুলাই শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরে শিক্ষার্থীরা যখন স্লোগান দেয়, ‘আমি কে, তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার’—যখন এই টার্মিনোলজি ভেঙে ফেললো, তখন বুঝেছি আর দমিয়ে রাখা যাবে না। এই স্লোগান রাস্তায় রাস্তায় দিয়েছে।
পরের দিন যুক্ত হলো, ‘কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ আর ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে যখন ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়, সেদিন আমি কনফার্ম হই।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না, সকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। প্রত্যেকটা হলে প্রভোস্টের কাছ থেকে সাইন নেওয়া হয় যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা-এটা অনেক বড় একটা ঘটনা। তখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে এই আন্দোলনকে আর থামানো যাবে না।
তবে কিছুটা হতাশ হয়েছি মাঝখানের পিরিয়ডে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়। ১৯ তারিখের পরেই কিছুটা স্থিমিত হয়েছে। এর পরের দিন নেমে দেখি—কয়েকশো মানুষ রাস্তায়। কিন্তু কোনো লিডার নেই। সবাই অপেক্ষা করছিল—কেউ একজন লিড দেবে।
পুরো রাস্তা হাঁটছি। হেঁটে হেঁটে দেখি আশেপাশে মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে কেউ একজন ডাকবে।
আপনি বলছিলেন যে ফেসবুক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু যখন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছিল, তখন কীভাবে আন্দোলনকে মোবিলাইজ করেছেন? সবার সাথে কীভাবে সংযুক্ত থেকেছেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: আমরা একটা মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করেছি—যেটা অফলাইনেও ব্যবহার করা যেত সে সময়। আমরা কয়েকজন সেটি ব্যবহার করছিলাম।
আর অফলাইনে আমরা অনেক কথা বলেছি। ঢাকার অনেক স্পটের মানুষের সাথে আমি সরাসরি যোগাযোগ করেছি। আপডেট দিচ্ছিলাম—কি হচ্ছে, না হচ্ছে।
সে সময় হেলিকপ্টার থেকে র্যাব গুলি করেছে। তখন কল করে এক স্পটের মানুষ, অন্য স্পটের মানুষজনকে জানাচ্ছিল—‘হেলিকপ্টার এখন আপনাদের দিকে যাচ্ছে।’
অনেক বড় নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবে মূল লিডারশিপের মধ্যে মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহৃত হয়েছে।
এই গণঅভ্যুত্থানটা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথমে শুরু হয়েছিল। সেটি পরবর্তীতে বৃহৎ আকার ধারণ করে। আপনি শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন, নাকি সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তর হওয়ার পরে যুক্ত হয়েছেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: ৫ জুন যখন আন্দোলন শুরু হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সেক্রেটারি ফরহাদ আমাকে ফোন দেয়। সে জানতে চায় আমাদের কি করা উচিত? এই আন্দোলনে আমরা কিভাবে যুক্ত হব? মূলত আলাপটা তখন থেকেই শুরু। আর আমি ডিপলি কানেক্টেড হই বাংলা ব্লকেট কর্মসূচি থেকে। আমি প্রত্যেকটা রাস্তায় গিয়েছি, বাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছি। কর্মসূচী প্রণয়ণে যুক্ত ছিলাম। মাঠে ছিলাম ১৫ জুলাই থেকে, প্রতিদিন রাস্তায় ছিলাম।
আন্দোলনের একটা কমন ব্যানার ছিল—বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কমন ব্যানারের কারণে শিবির সেটাতে দলীয় পরিচয়ে যুক্ত হয়নি নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল?
আলী আহসান জুনায়েদ: প্রথমত, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সবাই এক হয়েছে। তখন ওই ব্যানারটাকে পার্টিশন করে ফেলা খুবই বিপদজনক ছিল। তাতে করে আন্দোলনের সার্বজনীন রূপটা নষ্ট হয়ে যেত। আমরা দেখেছি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যারা লিডারশিপে ছিল, তারাও নিজেদের দলীয় ব্যানার ব্যবহার করেনি। ছাত্রদলসহ অন্যান্য সকল ছাত্র সংগঠন এই কমন ব্যানারে এসে যুক্ত হয়েছে। কেউ তার দলের নামটা ব্যবহার করেনি। যাতে করে সরকার এই আন্দোলনকে কোনো দিকে ঠেলে দিতে না পারে। যদিও চেষ্টা করেছে। হাসিনা ১৭ জুলাইও বলেছে এটা শিবির, বিএনপি, জামায়াতের ষড়যন্ত্র। আন্দোলনটাকে যেন সার্বজনীন রূপ থেকে পার্টিশন না করে জনগণের মধ্যে একটা কমন পালস তৈরি করা যায়। তাই শিবির বাইনেমে আসাটা আন্দোলনের জন্য ভালো হতোনা।
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খালি করার পরে আন্দোলনটা অনেকটাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা নেমেছে। এই আন্দোলন বিমুখ একটা ফোর্স পুরোপুরি আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে যাওয়াটা কীভাবে দেখেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ ১৭ই জুলাই হল ভ্যাকেন্ট করা হয়, তখন সবার মনে প্রশ্ন ছিল আন্দোলনের কী হবে এখন? পরের দিন ১৮ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে। শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের উপর এভাবে নির্মম গুলি চালানো তারা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। এটা অনেক বড় একটা ঘটনা। আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯ তারিখেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ৩১ জন শহীদ হয়। কিছু স্পটে যেমন উত্তরা, যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে ছিল। আহত, শহীদ তালিকায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নাম অনেক। ২, ৩, ৫ আগস্ট কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ একটা জাতীয় ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়।
আন্দোলনের সময় পুলিশ গণহারে গ্রেপ্তার করেছে। অনেকেই পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। তা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকাটা আপনার পরিবার কীভাবে নিয়েছিল?
আলী আহসান জুনায়েদ: আমার একটা সুবিধা ছিল। আমার বাসায় আমার আব্বা এবং তিন ভাই। আমরা চারজনই প্রতিদিন নেমেছিলাম। হয়তো স্পটের ডিফারেন্স ছিল। মাঝেমধ্যে ঢাকা আসছি। শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছি। মা এবং আমার ওয়াইফেরও যথেষ্ট সাপোর্ট ছিল। ভয়ভীতি নিশ্চয় ছিল। পালায়ে পালায়ে থাকা, সতর্ক থাকতে হয়েছে। কারণ বাসায় বাসায় পুলিশ ছাত্রলীগের তল্লাশি চলছিল। তারপরেও পরিবারের সদস্যদের মোটামুটি সাপোর্ট ছিল।
জুলাইয়ে সকল শ্রেণী, পেশা ও দলের মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি হয়। সেটা কি এখনো আছে?
আলী আহসান জুনায়েদ: ঐক্য নেই সেটা মনে করিনা। জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ তাড়াতে যে ঐক্য ছিল, সেটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার কাজে তৈরি করতে পারিনি। এখনো ঐক্য আছে, কিন্তু ইমপ্লিমেন্টেশন প্রসেস নিয়ে নানান কথা আছে। শহীদ-আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন সবাই চায়। জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র সবাই চায়। বিচার সবাই চায়। কিন্তু এগুলোর মধ্যে নানান পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন ঢুকে গেছে। এই পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন ঢুকার কারণে আজকে বৃহত্তর অর্জনটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। জুলাইয়ে ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যে ঐক্যটা ছিল, পরবর্তীতে জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে সেটার ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। কয়েকটা জায়গায় একমত হতে হবে — জাতীয় স্বার্থ, নাগরিক অধিকার এবং ন্যায্য সংস্কার। এই তিনটি প্রশ্নে এগ্রিমেন্ট লাগবে।
৫ তারিখ শেখ হাসিনা পালানোর খবর শোনার পরে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল? সেদিন কি করেছিলেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: আমি তখন যাত্রাবাড়ীতে ছিলাম। সেখানে থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে গেলাম। সেখানে অনেকের সঙ্গে কথা হলো। এরপর কেন্দ্রীয় মসজিদে যাই, সেখানে রাফে সালমান রিফাত, সাদিক কায়েমসহ কয়েকজন একসাথে ছিলেন। তারা পরে বর্তমান প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ভাইয়ের অফিসে গেলেন, আমি সরাসরি চ্যানেল ২৪ এর অফিসে গেলাম। আমার সাথে ছিলেন শরফুদ্দিন ভাই ও আতিক ভাই। ওদের সবার সঙ্গে দেখা হয় এবং সংবাদ সম্মেলনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
সংবাদ সম্মেলনের পর তারা কোথায় থাকবে তা নিয়ে আলাপ হয়। তখন আসিফ নজরুল স্যার চ্যানেল ২৪ এর নিচে আসেন। আসিফ, মাহফুজ, নাহিদরা তার সাথে দেখা করতে যায়। পরে কিছুক্ষণ যোগাযোগ বন্ধ থাকে, পরে ফোনে জানায় কোথায় থাকবে। তখন ধানমন্ডিতে আমাদের এক বড় ভাইয়ের বাসায় আসতে বলি। সেখানে নাহিদ, আসিফ, তুহিন খান, নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারি, আবু বাকের মজুমদার এসেছিল। মাহফুজ পরে রাতে আসে। রাতভর বিভিন্ন আলাপ আলোচনা হয়।
সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের খবর এবং থানা থেকে পুলিশ রাজারবাগে জড়ো হওয়ার খবর শুনেছি। সিনিয়র সিটিজেনদের সঙ্গে কথা হয়, তারেক রহমানের সাথেও যোগাযোগ হয়। শফিকুর রহমান ও মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে পরামর্শ আসতে থাকে যে এভাবে শূন্যতা রাখা যাবে না, কারণ পুরো রাষ্ট্র এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
আমরা সিদ্ধান্ত নিই, প্রফেসর ইউনুসকে প্রধান করে একটা ঘোষণা আসবে। রাতে লামিয়া মোরশেদের সঙ্গে সাদিক কায়েমের যোগাযোগ হয়। সে পজিটিভ রেসপন্স দেয়। রাত ৩-৩:৩০টার দিকে নাহিদ প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত করে। আমরা একটা স্ক্রিপ্ট লিখি, এরপর একটি ভিডিও বার্তায় নাহিদ, আসিফ এবং বাকের উপস্থিত ছিলেন, যেখানে নাহিদ ঘোষণা দেন রাষ্ট্রের প্রধান হবেন প্রফেসর ইউনুস। এতে কিছুটা উত্তেজনা কমে আসে।
পরের দিন ৬ আগস্ট সকালে সেই বাসা থেকেই নাহিদ ইসলাম আরেকটি ভিডিও বার্তা দেয়৷ সেখানে বলা হয় পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করতে হবে। তখন রাষ্ট্র ও সরকারের গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে, উপদেষ্টা ও দলগুলোর প্রধানদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সিনিয়র সিটিজেনদের পরামর্শে একটি তালিকা তৈরি করি, যা পরে প্রফেসর ইউনুসসহ অন্যদের পরামর্শে কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়।
জুলাই অভ্যুত্থান আপনার রাজনৈতিক অবস্থানে কেমন পরিবর্তন এনেছে?
আলী আহসান জুনায়েদ: এই আন্দোলন আমার রাজনৈতিক অবস্থানে গভীর প্রভাব ফেলেছে। গণঅভ্যুত্থান এবং মানুষের আত্মত্যাগ আমি নিজের চোখে দেখেছি, বিশেষ করে- আমি অন্তত ৫০ জন শহীদের লাশ সরাসরি দেখেছি মাঠে। এসব দেখে আমার ভেতর পুরোপুরি পরিবর্তন এসেছে। দেশের মানুষের জন্য নতুন এক স্বপ্ন জাগে আমার মনে। মনে হয়েছে, আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখি, সেখানে পৌঁছাতে পারব। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এক ধরনের হতাশা ছিল, মনে হত কোনো প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক ফাংশন করছেনা বা কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের পরে সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে গেছে।
অভ্যুত্থানের মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আছে। একটা স্বপন সবাই দেখছেন। আপনি কি মনে করেন জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা স্থায়ী হবে?
আলী আহসান জুনায়েদ : জুলাইয়ে প্রধান লিডিং ফোর্স ছিল ইয়াং জেনারেশন, তারা মূলত এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সিনিয়ররাও ছিলেন, তবে যেই তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের কারণে আমার মনে হয় জুলাইয়ের অনুভূতি টিকে থাকবে। গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হতাশাজনক ছিল, তাই জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা কিছুটা নিভু হয়ে গিয়েছে। তবুও তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখে মনে হয় এই আন্দোলনের ভাবনা এবং চেতনা স্থায়ী হয়ে থাকবে।
জুলাইয়ের শিক্ষাটা কী?
আলী আহসান জুনায়েদ: জুলাই আমাদের শিক্ষা দেয় যে পুরো একটা দানবীয় ব্যবস্থাকে গণমানুষ চাইলে নিঃশেষ করে দিতে পারে। কেউ ভাবেনি যে এরকম একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসনকে জীবন দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটা বড় সতর্কবার্তা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো একই রকম অন্যায় ও দমনমূলক ব্যবস্থা চালু করতে চায়, তারা টিকতে পারবে না, কারণ মানুষের একতা ও সাহস থাকলে ওই ব্যবস্থাকে সরানো যায়।
কেমন বাংলাদেশ চান?
আলী আহসান জুনায়েদ: আমি চাই সব রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকবে, যেমন আমরা অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে দেখি। জাতীয় স্বার্থের জন্য দলীয় সীমানা থাকবে না। সবার ভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ঐক্য থাকতে হবে। আমরা আর ফ্যাসিবাদ বা একতরফা হেজিমনি দেখতে চাই না। গুম-খুনের মতো অমানবিক ঘটনা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এমন হলে আমরা বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ এবং সত্যিকারের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে পারব। এছাড়া আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নীতি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে স্থায়ী হতে হবে। [সূত্র: বাসস]