
লাগাতার সুরক্ষা অভিযানে প্রাণ ফিরেছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে। কমেছে অপরাধীর দৌরাত্ম্য। থেমে গেছে গুলির শব্দ। বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। এবারই প্রথম প্রজনন মৌসুমে বন্ধ রাখা হয়েছে করমজল পর্যটন কেন্দ্র। দুই মাস আগে শুরু হওয়া এ অভিযানের কারণে বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে বনজ সম্পদ পাচারকারী, চোরা শিকারি ও বিষ সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার হচ্ছে হরিণ শিকারের ফাঁদ, নৌকাসহ মাছ ধরা জাল, বিষসহ চোরাই বনজ সম্পদ।
বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা এলাকার সুন্দরবন-সংলগ্ন লোকালয়ের বনজীবী আনোয়ার হোসেন, সোহরাব শিকদার, বিমল গাইন, এসকেন্দার বয়াতিসহ অনেকে জানান, বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও এর এক মাস আগে থেকেই সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ কঠোর নজরদারি শুরু করে।
বর্তমানে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে চোরাই পথে কেউ সুন্দরবনে ঢুকলেই গ্রেপ্তার হচ্ছে। আগে ঘুষ দিয়ে ছাড় পাওয়া গেলেও এখন গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। শরণখোলার আবুল কালাম ও মোংলার সনৎ হালদার জানান, তাদের সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় আগে সহজেই ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে হরিণের মাংস পাওয়া যেত। দূরের এলাকায় চোরা শিকারিরা হাজার টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস ‘হোম ডেলিভারি’তে পৌঁছে দিত। মে মাস থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে চোরা শিকারিরা সুন্দরবন থেকে দূরে থাকায় এখন হরিণের মাংস পাওয়া যাচ্ছে না।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, লাগাতার অভিযানে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে প্রাণ ফিরে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বন অপরাধীরা গহিন অরণ্যে হরিণ শিকারের যেসব ফাঁদ পেতে রাখত তা এখন বন বিভাগের অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে। এমন অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জানায়, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে প্রতি বছর ১ জুন থেকে তিন মাস বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে পর্যটক ও বনজীবীদের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২৯২ প্রজাতির মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে বাড়তি নজরদারি করে থাকে বন বিভাগ।
এবার প্রজনন মৌসুমের আগেই পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের নতুন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ঘোষণা দেন, বন অপরাধীদের ১ কেজি পরিমাণ জাল ও হরিণ শিকারের ফাঁদের খোঁজ দিলেই দেওয়া হবে ২ হাজার টাকা পুরস্কার।
প্রতিদিনই স্মার্ট প্যাট্রোলিং ও ফুট প্যাট্রোলিংয়ের ফুটেজ তার মোবাইলে পাঠানোর কড়া নির্দেশ দিলে ঘুম হারাম হয়ে যায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীদের। মে মাস থেকে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ কঠোর নজরদারির মধ্যে চলে আসায় প্রথমে দুজন চোরা শিকারিকে তিনটি মাথাসহ ৪২ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা। গত দুই মাসে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় ৮৬টি অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় তিন চোরা শিকারিসহ খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা আরও ৩১ জেলেকে। উদ্ধার করা হয় ১২৫ কেজির অধিক ওজনের মালা ফাঁদ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের আরও ৩ হাজার ৬৯৮টি ফাঁদ। ৫৩টি ট্রলার নৌকা, তিন টন ওজনের জাল, বিষযুক্ত ৩২৫ কেজি মাছ, ১৩টি বোতলভর্তি বিষ, মাছ ধরার ৫৩২টি চারু, ৪০০টি বড়শি, ১১০ কেজি রশি, ১৩ পিস সুন্দরী কাঠের বল্লী ও ৪৮টি সুন্দরী গাছের কচা জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত ৩০ জুন হরিণ শিকারে তৎপর পাথরঘাটার নাসির গ্যাংয়ের উপপ্রধান মো. আরিফুল ইসলাম দুলালকে (৫০) হরিণ শিকারের ৩০০টি মালা ফাঁদসহ গ্রেপ্তার করা হয়। শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্যের কাছে সুখপাড়া বন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বন বিভাগ। তার কাছ থেকে ছুরি, করাত, ২০০ গজ পলিথিন, ১১টি প্লাস্টিকের খালি বস্তা, ২টি পালিত ও ১০০ পুট প্লাস্টিকের রশি উদ্ধার করা হয়।
অভিযান চলমান থাকলেও দুর্গম এই বনে এখনো বন অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ড্রোন ব্যবহার করে অভিযানের ফলে নতুন করে সুন্দরবনে নামা পাঁচটি বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা পশ্চিম বিভাগের বনে সরে গেছে বলে জানায় বন বিভাগ।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে বন অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা বাস্তব পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। তবে অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। লাগাতার অভিযানে সেটাই আমরা করছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান এ বন কর্মকর্তা।