
দীর্ঘদিন দস্যুমুক্ত থাকার পর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে আবারও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পাঁচটি দস্যু বাহিনী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভসংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে জেলেরা জিম্মি রয়েছেন দস্যুদের কাছে। এসব বাহিনীর সদস্যরা জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ চাইছে। না হলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
কোস্ট গার্ড সূত্রে আরো জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এসব বাহিনী সুন্দরবনে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব বাহিনীর প্রতিটিতে ১০ থেকে ১৫ জন করে সদস্য রয়েছে। সুন্দরবনের চকপাড়া বাজার, মল্লাখালী, পুরাতন ঝাপসি, শিবসা নদীর আড় বাওয়ানী খাল, মুচিরদোয়ানি, কামারখোলা, আদাচাই, আদাছগিসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় এসব বাহিনী আস্তানা গেড়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও কারাগারে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় কারবন্দি অনেক দস্যু পালিয়ে যায়। সেই সঙ্গে র্যাব-পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে নতুন ও পুরনো কিছু সদস্য নিয়ে সুন্দরবনকেন্দ্রিক দস্যু বাহিনী সক্রিয় হয়েছে। সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে দস্যু বাহিনীর সদস্যদের আটক করা কষ্টসাধ্য। কারণ দুর্গম সুন্দরবনে স্বাভাবিকভাবে চলাচল সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যসহ অভিযান চালানোর মতো উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে সুন্দরবন পুরোপুরি দস্যুমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারের কাছে আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের অনেকে ফিরে এসেছে পুরনো পেশায়। যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। দস্যুদের পাঁচ বাহিনীর একটি হচ্ছে দয়াল বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্য প্রায় ১০ জন। সুন্দরবনের যে অংশে মজনু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল তা গত এপ্রিলে দয়াল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সূত্র জানায়, এ জন্য মজনু ও দয়াল বাহিনীর মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ টাকায় চুক্তি হয়েছে। বিনিময়ে ছয় মাস সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে দয়াল বাহিনীর কাছে। মজনু এরই মধ্যে ২০ লাখের বেশি টাকা পেয়েছে। বাকি অর্থ পাওয়ার আশাও করছে। মজনু তার বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দয়াল বাহিনীর কাছে দিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে। জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ, রমজাননগর, কৈখালী ও ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে দয়াল বাহিনীর দাপট রয়েছে। দয়াল বাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন বাহিনী এখন বিভিন্ন স্থানে ছয় মাসের জন্য জেলেদের নৌকাপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে। এ চাঁদা না দিলেই দস্যুরা নির্যাতন করে জেলেদের। করিম শরীফ বাহিনী জেলেদের ওপর নির্যাতন চালালেও তাদের সদস্যরা ধরা পড়ছে কম। গত ৯ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনের করকরি নদীর মল্লাখালী থেকে মুক্তিপণের দাবিতে এই বাহিনীর হাতে জিম্মি ১৬টি নৌকাসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। বাকি অন্যান্য বাহিনীও তৎপরতা চালাচ্ছে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জালাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সুন্দরবন দীর্ঘদিন ধরে বনদস্যু-জলদস্যুমুক্ত ছিল। জেলেরা শান্তিতেই ছিলেন। এ বছর নতুন করে দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব হয়েছে। এদের কারণে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার জেলেরা আতঙ্কে আছেন। সম্প্রতি চাঁদপাই ইউনিয়নের দক্ষিণ কাইনমাড়িতে নাথন নামের এক জেলেকে গভীর সমুদ্র থেকে অপহরণ করে দস্যু বাহিনীর সদস্যরা। পরে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে পরিবার নাথনকে ছাড়িয়ে আনে। এর পর থেকে পরিবারটি পথে বসেছে। তারা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। মোংলার চিলা ইউনিয়নের চিলা বাজারের বাসিন্দা জেলে চিত্ত মণ্ডল বলেন, ‘সুন্দরবনের দুবলার চরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। সেখানে আমাদের কয়েকজন জেলেকে দস্যুরা ধরে নিয়ে যায় ও মুক্তিপণ আদায় করে। এরপর যে কয়েক দিন দুবলার চরে ছিলাম ততদিন চরম আতঙ্কেই ছিলাম। দস্যুদের কারণে শত শত জেলে পরিবার আতঙ্কে আছে।’
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্র জানায়, সুন্দরবনে রাজত্ব ছিল জল-বন দস্যুদের। তাদের দাপটে জেলে, বাওয়ালি, মৌয়াল এমনকি বনরক্ষীরাও আতঙ্কে থাকতেন। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে অভিযান চালাতে ২০১২ সালে র্যাবের নেতৃত্বে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ২২৩টি অভিযানে নিহত হয় ১৩৫ দস্যু। একই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচ শতাধিক দস্যুকে। ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক দস্যুমুক্তকরণ কার্যক্রম। এরপর ৩২টি বাহিনীর ৩২৪ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করে। আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের অনেকে ফিরছে তাদের পুরনো পেশায়।
সুন্দরবনের জলসীমার অধিকতর সুরক্ষায় সম্প্রতি বয়াসিং এলাকায় ভাসমান বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) উদ্বোধন করা হয়েছে। বিজিবির এই বিওপি ছাড়াও সুন্দরবন ও জেলেদের রক্ষায় র্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের লোকজনকে আরো তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরও দস্যুদের তৎপরতা কমছে না।
কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. আশিকুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে সুন্দরবনে পাঁচটি দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এসব বাহিনীর তৎপরতা রুখে দেওয়ার পাশাপাশি দস্যু নির্মূলে কোস্ট গার্ড নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এসব অভিযানে মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত জেলে-বাওয়ালিদের উদ্ধারসহ বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন রক্ষায় কোস্ট গার্ড অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিতভাবে অভিযান পরিচালনা করছে।
বাগেরহাটের সহকারী পুলিশ সুপার (মোংলা সার্কেল) মুশফিকুর রহমান তুষার বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর সুন্দরবন ও সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে নতুন করে কিছু দস্যুর তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। দস্যু দমনে অভিযান চালাতে পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে।’