Image description
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী অভিযান শুরু হয়নি বিআরটিএ- দায় নিতে চাচ্ছে না মালিক সমিতির দাবি তাদের নিজস্ব অভিযান চলমান

কথা ছিল ১ জুলাই থেকে রাজধানীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। কিন্তু তা হয় নি। বরং আগের মতোই দাপিয়ে চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এখনও লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহনের দখলে রাজধানীর সড়ক। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয় মাস সময় বেঁধে দিলেও আসেনি ইতিবাচক পরিবর্তন। বিআরটিএ-এর কর্মকর্তরা বলছেন, তারা এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাননি। আর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সাইফুল আলম দাবি করেছেন, সমিতির পক্ষ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ইতোমধ্যে এক তৃতীয়াংশ লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাস আমরা রাস্তা থেকে তুলে দিয়েছি। বাকিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে।

ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, কালো ধোঁয়ায় সড়ক অন্ধকার করে ছুটে চলছে বহু বাস। অনেকগুলোরই সিগনাল লাইট নষ্ট, ভাঙা গ্লাস আর চাকার অবস্থাও নাজুক। মরিচায় আচ্ছাদিত জোড়াতালি দেয়া বডিও খসে পড়ার উপক্রম। এমন লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর প্রতিটি সড়কে।

বিশেষ করে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে যেসব যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে সবই লক্কর-ঝক্কর মার্কা। বেশিরভাগ বাসের বডির রঙ চটানো, সামনে অথবা পেছনের অংশে ভাঙ্গা, ছাদ ফুটো, সীটের সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। তাও আবার নড়বড়ে। অনেকের মতে, ঢাকার হযরহ শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে একজন বিদেশি অতিথি বাসগুলো দেখে সহজেই অনুমান করতে পারবেন এদেশের কী অবস্থা। তাদের কাছে বিনিয়োগ আশা বা দাবি করা কতটা সমুচীন সেটা ভাবনার বিষয়। একজন বিদেশি যখন ঢাকায় প্রবেশ করেই এরকম দুর্দশা দেখতে পান, তখন তার আর বুঝতে বাকি থাকে না এদেশের অবস্থা কতটা নাজুক।
এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটসেবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়। এসময় গাবতলী বেড়িবাঁধ এলাকার গাড়ির বডি তৈরির প্রতিষ্ঠান মাওয়াহীদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ থেকে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে অংশ নেন মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো.রাহাত গাওহারীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সে সময় বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো.আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা থেকে প্রচুর মানুষ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে এবং ঈদ শেষে ঢাকায় আবার ফিরে আসবে। এই ঈদকে কেন্দ্র করে ফিটনেসবিহীন ও লক্কড় ঝক্কড় গাড়ি যাতে রাস্তায় না নামতে পারে সেজন্য গাড়ির যে গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপগুলো আছে আমরা তাদেরকে সচেতনতামূলক একটি মোবাইল কোর্ট করছি। এই সব গ্যারেজ থেকে রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি যাতে তারা না নামায়। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যে এসব গাড়ি রাস্তায় চলাচল করলে একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে দীর্ঘ একটা যানজট সৃষ্টি হয় এবং মানুষের জীবন ও হুমকির মুখে পড়ে। এগুলো যাতে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি এই কারণেই ওয়ার্কশপগুলোতে মোবাইল কোট করছি এবং তাদেরকে সতর্ক করছি। সড়কে যে সব ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে ধরার বিষয়ে পদক্ষেপ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এদের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে জেল জরিমানা উভয় শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা আছে। উল্লেখ্য ওই কারণে এবার ঈদুল ফিতরে নির্বিঘেœ মানুষ ঘরে বাড়ি যেতে পেরেছে। পথে কোনো যানজট হয়নি। কিন্তু পরে ঈদুল আযহায় ঈদযাত্রা ততটা সুখকর হয়নি। মহাসড়কে বিভিন্ন ধরনের যান অচল হয়ে পড়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যমুনার এপাড়-ওপাড়ে যানজটে আটকা পড়ে ৭ ঘণ্টা পথ ১৪ ঘণ্টাও লেগেছে।

বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০ হাজার ৮৬৮টি বাস, ১১ হাজার ১৮৫টি মিনিবাস, ৫৭ হাজার ৪১টি ট্রাক, ৭৩ হাজার সাতটি প্রাইভেটকার, ৩০ হাজার ৫৩৮টি মাইক্রোবাস, ৭২ হাজার ১৫৯টি পিকআপ ভ্যান, ৩৯ হাজার ৫৯১টি ট্রাক্টর, ১৪ হাজার ৩৮০টি হিউম্যান হলার, ৩ হাজার ৮১১টি অ্যাম্বুলেন্স, ২ লাখ ৫ হাজার ৬৪৭টি অটোরিকশার ফিটনেস বা হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়াও দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৬২ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মোটরসাইকেল।

অথচ রাজধানীতে চলতি মাস থেকে গণপরিবহনের এমন চিত্র আর দেখার কথা ছিল না। গেল বছরের অক্টোবরে ৬ মাস সময় বেঁধে দিয়ে ফিটনেসবিহীন এসব যানবাহন বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। বাস্তবতা হলো, সরকারি ঘোষণা তোয়াক্কা না করেই সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন। সেবার মানেও কোনো পরিবর্তন না আসার অভিযোগ যাত্রীদের। যাত্রীদের অভিযোগ, বেশির ভাগই বাসেরই গ্রাস ভাঙা থাকে। বৃষ্টির কারণে বসা যায় না। এছাড়া ফ্যানগুলোও নষ্ট থাকে। গরমে খুব অস্থির লাগে।

এদিকে কোনোরকম জোড়াতালি আর নামমাত্র রঙ দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছন বাস মালিকদের কেউ কেউ। ওয়ার্কশপে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, দৃশ্যত পরিবর্তন হলেও কার্যত কোনো সমাধান হয় না। যাত্রীদের অভিযোগ ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবস্থা যেমনই হোক তা নিয়ে যেন কোনো মাথাব্যথা নেই মালিকদের। এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, রাস্তায় লক্কর-ঝক্কর গাড়ি দেখলে আমাদেরও লজ্জা লাগে। আমরা বার বার মালিকদের সতর্ক করেছি। যারা এই সতর্কতা মানছে না তাদেরকে রাস্তা থেকে তুলে দিচ্ছি। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, সিএনজি অটোরিকশার ক্ষেত্রে যেমন রিপ্লেসমেন্টের একটা সুযোগ আছে, মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাকের ক্ষেত্রে তেমন একটা নিয়ম থাকা জরুরি। ধরেন একজন মালিকের একটাই বাস আছে। যেটার ইনকা দিয়ে ওই মালিক জীবিকা নির্বাহ করে। তাহলে সেই বাস তুলে দিলে তার জীবিকার কী হবে? সেক্ষেত্রে তাকে সহজ কিস্তিতে নতুন বাস কেনা বা সরকার থেকে সাহায্য করার একটা নিয়ম থাকা দরকার। তাহলে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলো সরালে অটোমেটিক নতুন বাস রাস্তায় নামতে। যাত্রী সেবার মানও বাড়তো।

এদিকে, নতুন বাস নামোনোর আগে পুরনোগুলোর আপসারণের উদ্যোগ কাজে আসবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। মহাসচিব বলেন, একটি রোড থেকে একটি বাস উচ্ছেদ করতে চাইলে এর বিপরীতে আরেকটি বাস নামাতে হবে। নতুন বাস নামানোর কোনো পরিকল্পনা না নিয়ে শুধু উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাবে না। এ বিষয়ে বিআরটিএ-এর পরিচালক (অপারেশন) মীর আহমেদ তরিকুল ওমরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো নির্দেশনা পাইনি। চেয়ারম্যান স্যার বলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব এনফোর্সমেন্ট বিভাগের, আমার নয়।

একই প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অভিযান শুরু হবে। এটাতো বাতিল করা হয়নি। সারাদেশে এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। এই মুহূর্তে অভিযান শুরু হলে যদি গণপরিবহনের মালিকরা পরিবহন বন্ধ করে দেয় তাহলে পরীক্ষার্থদের অসুবিধা হবে। মূলত এই কারণেই অভিযান শুরু করা যায়নি। তবে আগামীতে সুবিধাজনক সময়ে অভিযান শুরু হবে।

এদিকে, আজ ৩ জুলাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফিটনেস প্রদান সংক্রান্ত একটা সভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত সেটি স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, সভাটি ছিল মূলত সরকারের বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষকে ফিটনেসের দায়িত্ব দেয়া। যেমনটি আওয়ামী সরকারের আমলে ভারতীয় কোম্পানীকে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাপানোর কাজ দেয়া হয়েছিল। তারা গ্রাহকদের সেবা তো দিতে পারেনি। বরং লাখ লাখ লাইসেন্স আটকে রেখে বছরের পর বছর গ্রাহককে ভোগান্তিতে ফেলেছে। যার জের এখনও বিআরটিএ-কে টানতে হেেচ্ছ। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন সেইসব ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফিটনেসের কাজ দিলে তারা আরও বেশি দুর্নীতি করবে। তার চেয়ে বরং বিআরটিএ-এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরিঅ। তিনি বলেন, যদি দেয়াই লাগে তাহলে সেখানে যেন বিআরটিএ-এর একজন ইন্সপেক্টরকে অবশ্যই রাখা হয়।