
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বলেছেন, সিলেট সম্পর্কে বর্তমান ডিসি’র ধারণা নেই। তার কারণে সিলেটের নানা সমস্যা এখন পুঞ্জিভূত হচ্ছে। সামাজিকভাবে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে । এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ডিসিকে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে তিনি পরিবহন শ্রমিকদের দেয়া আল্টিমেটামে একাত্ম প্রকাশ করেছেন। গতকাল সিলেটের কোর্ট পয়েন্টের এক সমাবেশে জেলা প্রশাসককে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে নিতে দুইদিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ময়নুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, ৪ঠা জুলাইয়ের মধ্যে ডিসিকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে না নিলে ৫ই জুলাই থেকে সিলেটে কোনো গাড়ির চাকা চলবে না। এই দাবিতে অনঢ় রয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ডিসি’র বিরুদ্ধে কেন এই ক্ষোভ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সিলেটে যোগ দিয়েছিলেন বর্তমান জেলা প্রশাসক। এই সময়ে সিলেটে নানা সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হচ্ছে- সিলেটের পাথর কোয়ারির ইজারা বন্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট জুড়ে বালু লুটের মহোৎসব চলছে। প্রশাসন ও পুলিশ এ ব্যাপারে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বরং তারা বালুখেকোদের পক্ষালম্বন করছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ও লাখো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্টোন ক্রাশার মিল বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভেঙে দেয়া হয়েছে অর্ধশতবর্ষী প্রতিষ্ঠান মেজরটিলা চক্ষু হাসপাতালের মার্কেট। পূর্বের ডিসিদের দেয়া লিজকৃত মার্কেটকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে সেটি ভেঙে দেয়ায় ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে মাঠে নেমেছেন। এ নিয়ে মঙ্গলবার রাতে নিজের বাসার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেছেন আরিফুল হক চৌধুরী।
সেখানে তিনি জানান, অনেক আগে সিলেটের আরেক জেলা প্রশাসক এই জমি লিজ দিয়েছিলেন। এখন যদি তাদের উচ্ছেদ করতে হয়, তাহলে আলোচনাক্রমে করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না করে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। এটা অগ্রহণযোগ্য। কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। সিলেটে বর্তমান সংকটের বিষয়টি ইতিমধ্যে নোট করে নিয়েছেন জেলা প্রশাসক মাহবুব মুরাদ।
তিনি গতকাল সকালে সংক্ষুব্ধদের সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়ে বৈঠকের আয়োজন করেন। কিন্তু এতে উপস্থিত হননি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তারা জেলা প্রশাসকের দাওয়াতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডিসি অফিসের পার্শ্ববর্তী স্থানে সমাবেশের আয়োজন করেন। আর এই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। সেখানেই জেলা প্রশাসককে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। একইসঙ্গে আরিফুল হকও এই কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সমাবেশে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক তার বক্তব্যে সাম্প্রতিক সময়ে বালু ও পাথর লুটের জন্য জেলা প্রশাসককে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এনসিপি’র নেতা সারজিস আলম বলেছে সিলেটের দুই হাজার কোটি টাকার পাথর বিএনপি লুট করেছে। অথচ দুর্বৃত্তদের সঙ্গে নিয়ে সিলেটের প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা এই পাথর লুট করেছে। আর এখন দোষ দেয়া হচ্ছে বিএনপি’র ঘাড়ে। তিনি বলেন, জাফলংয়ের দুই দুর্বৃত্তকে বিএনপি দল থেকে বহিষ্কার করেছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে না গিয়ে পুলিশ তাদের সঙ্গে নিয়ে এই লুটপাট চালিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে পুলিশ আর সিলেটের মানুষের ক্ষোভ কন্ট্রোল করতে পারছে না। ডাক দিতে হচ্ছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে। অথচ সেনাবাহিনীর কাজ এটা না। প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ার কারণে সেনাবাহিনীকে সবকিছু কন্ট্রোল করতে হচ্ছে।
সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, সিলেটের ডিসি বলছেন এক আর কাজ করছেন আরেক। তার ওপর মানুষের আস্থা উঠে গেছে। সিলেটের পাথর কোয়ারির লিজ বন্ধ রেখে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। পাথর উত্তোলন বন্ধ না করে পরিবহন শ্রমিকদের নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ কারণে আমরা ঘোষণা করেছি ৪ঠা জুলাইয়ের মধ্যে ডিসিকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার না করলে ৫ই জুলাই থেকে সিলেটে গাড়ির চাকা ঘুরবে না। অর্থাৎ সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করা হবে। এই কর্মসূচির সঙ্গে সিলেটের মানুষ একাত্ম রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, ডিসি প্রত্যাহারের এই আন্দোলনকে পাঁচ দফা আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তাদের এই পাঁচ দফার মধ্যে রয়েছে- বন্ধ থাকা পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেয়া, ক্রাশার মেশিন ধ্বংসের অভিযান বন্ধ করা, পাথর পরিবহনকারী ট্রাক আটকের অবসান, চালকদের হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ সহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কোম্পানীগঞ্জের আব্দুল জলিল ও জৈন্তাপুরে নীপু জানিয়েছেন, স্টোন ক্রাশার মিলে অভিযানের ফলে ইতিমধ্যে কয়েকশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অথচ অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ না করে অভিযান চালানো অমানবিক। জেলা প্রশাসকের এই একচোখা আচরণ কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি করেন তারা। এদিকে, বাইরে যখন সমাবেশ চলছিল তখন নিজ কার্যালয়ে সংক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসক। বৈঠকে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন পাথরব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, এলসি করা পাথর সীমান্ত দিয়ে আসার পর যেভাবে আসছে সেভাবেই ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে হবে। পরে আমদানি করা পাথর ভাঙার পর আবার কি ঢাকা থেকেই কিনে আনতে হবে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন বলে জানান তারা।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, সার্বিক বিষয়টি জেলা প্রশাসক তার নোটে নিয়েছেন। আইনে থাকায় অনেক কিছুই তাকে করতে হয়। ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সুবিধার্থে কিছু বিষয়ে সংবেদনশীল হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিকালে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী মানবজমিনকে জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফাভাবে আইন প্রয়োগ করে সিলেটে সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়েছেন। বৈঠক করে সেই অস্থিরতা কমানো যাবে না। বরং ব্যর্থতার জন্য তাকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে নিলে জনমনে জন্ম নেয়া ক্ষোভ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।