
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ বিষয়ে আইজিপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিট প্রধান এবং গোয়েন্দা প্রধানদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে-এটা ধরে নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠকে। নির্বাচনের সময় যাতে যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দির ভেতর পুলিশ সদস্য ঢুকতে না পারেন সে বিষয়ও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কোনো বিশেষ প্রার্থীকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া যাবে না। এ সংক্রান্ত নির্দেশ পাওয়ার পর ৩ জুন থেকে নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। ইতোমধ্যেই দুটি কর্মশালা শেষ করা হয়েছে। সবশেষ মঙ্গলবার অতিরিক্ত আইজিপি আবু নাসের মোহাম্মদ খালেদের সভাপতিত্বে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এর আগে ১৯ জুন প্রথম কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের সময় পুলিশের দায়িত্ব কী সেটা আইনে বলা আছে। কিন্তু বিষয়টি ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে পুলিশ এখতিয়ারবহির্ভূত অনেক কাজ করেছে। এবার যাতে ওই কাজগুলো পুলিশ না করে সে বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে আইজি পর্যন্ত-সব পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে একটি এবং অক্টোবরে আরেকটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রশিক্ষণ চলাকালে নির্বাচন পরিচালনার বিষয়টি মহড়া আকারে হাতে-কলমে শেখানো হবে। এছাড়া একই অপরাধ দেশের যে প্রান্তেই হোক না কেন আইনের একই ধরনের প্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানায়, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পুলিশের করণীয় নির্ধারণে সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদস্যদের কীভাবে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, দুটি কর্মশালায় সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। কর্মশালায় আইনের সঠিক প্রয়োগের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনকালীন সময় পুলিশ সদস্যরা কীভাবে কাজ করবেন সে বিষয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে তুলে দেওয়া হবে ওই ডকুমেন্টারি। পাশাপাশি কাজ চলছে প্রশিক্ষক তৈরির। প্রশিক্ষকরা যেসব বিষয়ে প্রশক্ষিণ দেবেন সে সবের কনটেন্টও তৈরি হচ্ছে। সূত্র জানায়, নির্বাচনসংক্রান্ত ডকুমেন্টারি তৈরিতে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রথমে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে তফশিল ঘোষণার আগের পরিস্থিতিকে। এখানে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য, ষড়যন্ত্র, দলীয় কোন্দল, আগের নির্বাচনে এলাকার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় থাকছে। দ্বিতীয় প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে তফশিল ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পুলিশের আচরণ, প্রার্থীর নিরাপত্তা, প্রচারণা, ঝঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র, আন্তঃবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর ভূমিকা, কন্ট্রোল রুমের ভূমিকা, কুইক রেসপন্স টিম, ব্যালট পেপার পরিবহণ, নির্বচনি দায়িত্বে নিয়োজিতদের নিরাপত্তা, নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করা, ভোটার ব্যবস্থাপনা, ভুয়া ভোটারের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ, ভোট গণনার সময় পুলিশের দায়িত্ব, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে আচরণ, নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় থাকছে।
সূত্র আরও জানায়, আইনে নির্বাচনসংক্রান্ত পুলিশ রিলেটেড যেসব বিষয় আছে সেগুলোকে একত্রিত করে পকেট ডায়েরি (বুকলেট) তৈরি করা হবে। যেটি সব পুলিশ সদস্যের হাতে থাকবে। আর এটি করা হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ সহজতর হবে। আইনে বলা আছে, একজন প্রতিবন্ধী লোক ভোট দিতে এলে তিনি অন্য একজন লোকের সহায়তায় কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন। আর ওই লোকটি নির্ধারণ করবেন প্রতিবন্ধী নিজে। কিন্তু নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, মানবিকতা দেখানোর নামে পুলিশ নিজেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে যাচ্ছেন। অথচ নির্ধারিত সীমানার ভেতর প্রবেশের এখতিয়ার পুলিশের নেই। পুলিশ এ ধরনের কোনো কাজ যেন করতে না পারে সে বিষয়টি খেয়াল রাখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশের প্রশিক্ষণ কোথায় এবং কীভাবে হবে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রথম প্রশিক্ষণটি হতে পারে রাজারবাগে। এই প্রশিক্ষণে এসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ হবে পুলিশের সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ ও মেট্রোপলিটন কার্যালয়ে। ঢাকায় যারা প্রশিক্ষণ নেবেন তারা প্রশিক্ষক হয়ে রেঞ্জ ও মেট্রোপলিটন এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন যে ভিডিও করা হবে সেটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যেই নির্বাচনসংক্রান্ত সচেতনতা তৈরি হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। আমরা এমনভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি যখনই তফশিল ঘোষণা হবে, তখনই যেন নির্বাচনি মাঠে নামতে পারি।