Image description

বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিল রাহাত হোসেন শরীফ। লক্ষ্য ছিল জার্মানিতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। ইউটিউব দেখে শেখা শুরু করেছিল জার্মান ভাষা, বন্ধুদের সঙ্গে স্বপ্ন ভাগ করে বলত—আমি একদিন দেশের বাইরে পড়তে যাব। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই সব শেষ। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় সদ্য এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্র রাহাত।

রাহাত ভর্তি হয়েছিল উত্তরা আজমপুরের নবাব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মানবিক বিভাগে নতুন ক্লাস শুরু করার কেবল ক'দিন পরেই, তার জীবন থেমে গেল চিরতরে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনে, কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় আচমকাই গুলিবিদ্ধ হয় রাহাত। সে আর ফিরতে পারেনি মায়ের কোলে।

গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা সন্ধ্যা সাতটায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাহাতের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা থানার বাহেচর গ্রামে। বাবা মো. সেলিম ফারাজী পেশায় একজন প্রবাসী, বর্তমানে সৌদি আরবে। একমাত্র সন্তান রাহাতকে ঘিরেই বাবা-মায়ের জীবন আবর্তিত হতো। মা স্বপ্না আক্তার বলেন, "ও আমার একমাত্র ছেলেটা ছিল। কারও সঙ্গে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করত না। নিয়মিত নামাজ পড়ত। বিদেশে গিয়ে লেখাপড়ার স্বপ্ন দেখত। ইউটিউব দেখে নিজে নিজেই জার্মান ভাষা শিখত। আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা পারি, সবই ওর জন্য করব। কিন্তু কে জানত আমাদের সব স্বপ্ন এইভাবে গুলিতে ঝরে যাবে!"

স্বপ্না আক্তারের গলা ভেঙে আসে কান্নায়—‘২০ বছরের সংসারে আমাদের একটাই সন্তান ছিল। আমি এখনও ওর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাই। কখনো হঠাৎ জেগে উঠি, ভাবি—ও পাশে ঘুমাচ্ছে কি না। এরপর বুঝতে পারি, ও তো আর নেই... এটা মনে হলে আমি মূর্ছা যাই।’

রাহাতের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাদের গ্রামের বাড়ি বাহেচর গ্রামে। দাফন করা হয় দাদার কবরের পাশেই। রাহাত মারা যাওয়ার দুই মাস পর ঢাকার বাসা ছেড়ে মেয়ে ফিরে যান গ্রামে—সেই ঘরে, যেখানে এখন শুধু ছেলের শূন্যতা।

রাহাতের বাবা সেলিম ফারাজী ছেলের মৃত্যুর সময় দেশে আসতে পারেননি। কঠোর শ্রম আইনের কারণে ছুটি পাননি। সেই অভিমানে এখনো সন্তানহীন একাকিত্বের জীবন কাটাচ্ছেন প্রবাসে।

স্বপ্না আক্তার বলেন, আমরা গরিব ছিলাম, কিন্তু কখনও ছেলের চোখে সেটা পড়তে দিইনি। রাহাতই ছিল আমাদের আশার আলো। সেই বন্দুকের গুলি শুধু আমার ছেলেকে হত্যা করেনি, আমাদের গোটা ভবিষ্যৎকেই ধ্বংস করে দিয়েছে।

এই শহীদ মা শেষ কথা বলেন, চোখের জল মুছতে মুছতে—ও পড়তে চেয়েছিল, দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। আজ তার জায়গায় খালি কবর। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আমার ছেলে কি কোনো অন্যায় করেছিল, যে তাকে এইভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হলো?

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।