Image description
 

‘এই যে আমাকে মারতে ছিল, এই মারার টাইমে ওরা আবার গান ছাড়ছে, হিন্দি গান বাজাইতো।’ গুম সংক্রান্ত কমিশনের কাছে নির্যাতনের এই বর্ণনা দিয়েছেন একজন ভুক্তভোগী। আরেক ভুক্তভোগীর ভাষ্য, ‘ঘুমাতে নিলে, একজন আইসা বলতেছে, ‘এই ঘুমাইতেছেন কেন? মানে ঘুমাইতে দিতো না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পরে বালিশ সরাই ফেলতো। একদম শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলছে। আর এমনি শাস্তি দিতো। চেয়ার ছাড়া খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসায় রাখতো। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাফ পরায়া বিছানার পাশে আটকে দিয়ে রাখতো। মশা কামড়াইতো। কষ্ট পাইতাম আর কী। এরকম শাস্তি দিছে আর কী।’

শুধু মারধর বা ঘুমাতে না দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না নির্যাতনকারীরা। ছিল থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থা। গোপনীয়তাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও অপমানকর সেল জীবন। নারীদের দেওয়া হতো বিশেষ শাস্তি। ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে, উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো, নখ উপড়ে ফেলা, বাঁশ ডলা, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটার বোর্ডিং, ঘূর্ণায়মান চেয়ারের মাধ্যমে নির্যাতন, প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শকসহ ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের।

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে এসব ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (১ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গুম সংক্রান্ত দ্বিতীয় প্রতিবেদনের ‘নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্মোচন’ অধ্যায়টি পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরুষ ভিকটিমদের জন্য সেলের ভিতরের গোপনীয়তার অভাব ছিল বিশেষভাবে নির্মম। ছোট এবং সংকীর্ণ সেলগুলোতে লো প্যান লাগানো থাকতো বাথরুম ব্যবহারের জন্য। তবে কোনও পার্টিশন না থাকার কারণে শোয়ার সময় তাদের দেহ ওই প্যানের ওপর চলে যেতো। ফলে ময়লা, মূত্র এবং মলমূত্রের মধ্যে শোয়ার কারণে তাদের অসম্ভব অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তার চেয়েও খারাপ ছিল, সেলে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা। তাদের সব কার্যক্রম নজরদারিতে রাখতো। ফলে সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্ত যেমন প্যান ব্যবহার করার সময়ও লজ্জাজনকভাবে নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ভিকটিমদের অবস্থা সামান্য ভালো ছিল। সাধারণত ছোট একটি দেয়াল থাকলেও তা পুরোপুরি গোপনীয়তা দিতো না, শরীরের উপরের অংশ খোলা থাকতো। একটানা নজরদারির মধ্যে টয়লেট ব্যবহার করা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মর্যাদা রক্ষা না করতে পারা এই দেহগত অস্বস্তিকে আরও তীব্র করে তুলতো। কিছু নারী জানিয়েছেন যে তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘ওড়না’ পরতে না দেওয়ার কারণে তারা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণহারে ব্যবহৃত দ্বিতীয় সর্বাধিক সাধারণ নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল বৈদ্যুতিক শক প্রদান। সম্ভবত এ ধরনের যন্ত্র সহজে পাওয়া যায় বলেই এটি বেশি ব্যবহৃত হতো। অপহরণে ব্যবহৃত গাড়িগুলোতেও এটি বহনযোগ্যভাবে ব্যবহার করা হতো। এক সৈনিক স্মরণ করেছিলেন, তার কমান্ডার এই পোর্টেবল বৈদ্যুতিক শক যন্ত্রটিকে ‘বলস মেশিন’ বলে উল্লেখ করতো- যা অশালীনভাবে ইঙ্গিত করতো শরীরের কোন অংশে শক দেওয়া হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের সময় ব্যবহৃত ঘূর্ণন যন্ত্র নিয়ে একাধিক বিবরণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সাক্ষ্য থেকে দুটি পৃথক ধরনের যন্ত্রের কথা জানা গেছে। প্রথমটি, যা সাধারণত র‍্যাবের সাথে সম্পর্কিত। এটি একটি ঘূর্ণন চেয়ার। যেখানে ভুক্তভোগীদের অত্যন্ত উচ্চ গতিতে ঘুরানো হতো। যার ফলে প্রায়ই বমি, মূত্রত্যাগ, মলত্যাগ এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতো। এই যন্ত্রটি টিএফআই (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন) সেল এবং বিভিন্ন র‍্যাব ব্যাটালিয়নে পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় ধরনের ঘূর্ণন যন্ত্র, যা মূলত ডিজিএফআই-এর জেআইসিতে আটক ভুক্তভোগীদের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে, সেটি চেয়ার নয়, বরং পুরো শরীরের একটি যন্ত্র যেখানে ভুক্তভোগীকে বেঁধে রাখা হতো এবং যন্ত্রটি প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরানো যেতো।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ফলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ট্রমা, শিক্ষাজীবনের ব্যাঘাত এবং চলমান চিকিৎসা বা মনোরোগ সংক্রান্ত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হওয়ার খরচ সহজে পরিমাপযোগ্য নয় এবং তা স্বল্পমেয়াদি নয়। তদন্ত চলাকালে সবচেয়ে জটিল ও সময়সাপেক্ষ শনাক্তকরণের কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল এক পুরুষ ভুক্তভোগীর পরিচয় শনাক্ত করা, যিনি গোপন আটক অবস্থার একাধিক বেঁচে ফেরা ব্যক্তির সাক্ষ্যে বারবার উঠে এসেছেন।

সাক্ষীরা বর্ণনা করেছেন, অপহরণের সময় ছেলেটির বয়স আনুমানিক ১৫ বা ১৬ বছর ছিল, এবং তাকে টিএফআইতে আটক অবস্থায় মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের লক্ষণ প্রদর্শন করতে দেখা গিয়েছিল। একাধিক বর্ণনা অনুসারে, সে নিয়মিত কান্না করতো, আর প্রহরীরা এর জবাবে শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতো। অনেক বন্দি তার উপস্থিতির কথা বারবার উল্লেখ করলেও, আমরা শুরুতে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারিনি বা তাকে মুক্তির পর কী হয়েছিল তা জানতে পারিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন প্রাক্তন বন্দি প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি ওই ছেলেটিকে মুক্তির কয়েক মাস পর কাশিমপুর কারাগারের ‘পাগলা সেল’-এ মানসিক রোগীর সেলে আটক অবস্থায় দেখেছেন এবং তার নখ উপড়ানো ছিল, যা নির্যাতনের চিহ্ন হতে পারে। তিনি কিছু চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য এবং আনুমানিক সময়কাল জানাতে পেরেছিলেন। এর ভিত্তিতে টিম ওই সেলের রেজিস্ট্রি ডেটা সংগ্রহ করে। তবে নিশ্চিত নাম না থাকায়, সংশ্লিষ্ট এন্ট্রির সাথে মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গুমের যে ব্যবস্থা চালু ছিল, তা নির্যাতনের একটি বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগত সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। এই সংস্কৃতি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি স্বাভাবিকীকৃত প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন অঞ্চল এবং বছরের ভিন্ন ভিন্ন ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য থেকে প্রাপ্ত ধারাবাহিক প্যাটার্ন দ্বারা প্রমাণিত। এই বর্ণনাগুলো তুচ্ছ থেকে ভয়াবহ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার পরিসরকে ধারণ করে, যা প্রমাণ করে যে নির্যাতন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রোথিত ছিল। মানসিক নির্যাতন সর্বত্র ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি আটক কেন্দ্রে আমরা বিশেষ নির্যাতন কক্ষের খোঁজ পেয়েছি, যেখানে নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি রাখা হতো। ৫ আগস্টের পর এই প্রমাণগুলো ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এমন কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি, যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সাথে মিলে গেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানে শব্দরোধী দেয়ালের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা ভুক্তভোগীর চিৎকার বাইরে না পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। কোনও কোনও কেন্দ্রে ইন্টারোগেটরদের আনন্দের জন্য এবং নির্যাতনের শব্দ ঢাকতে গান বাজানো হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ভয়াবহ নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীরা প্রায়ই গুম অবস্থায় আটক থাকতেন, যা অপরাধীদের আইনগত প্রতিরোধের ভয় ছাড়াই নির্যাতন চালিয়ে যেতে দিতো। একজন ভুক্তভোগী আদৌ আদালতে হাজির হবে নাকি রাষ্ট্রের নথি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে, এই অনিশ্চয়তা অপরাধীদের অবাধে নির্যাতন করার সুযোগ করে দিতো। নির্যাতনকারীরা যদি কোনও অতিরিক্ত নজরদারির আশঙ্কা করতো, তাহলে নির্যাতনের প্রমাণ লোপাটের পদক্ষেপ নিতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়মিত একই ধরনের কর্মীদের যুক্ত থাকা প্রমাণ করে যে এই নির্যাতন একটি ধারাবাহিক ও সংগঠিত প্রচেষ্টা ছিল। এ জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, কর্মী প্রশিক্ষণ এবং পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ করতে হতো, যাতে এই ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চালু রাখা যায়। নির্যাতনের বিস্তার এবং এর স্থায়ী রূপ প্রমাণ করে যে এটি শুধু মাঠপর্যায়ে অনুমোদিত ছিল না, বরং শীর্ষ পর্যায়ের ক্ষমতাসীনদের সহায়তা ও অনুমোদনও পেয়েছিল। অবকাঠামো নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হতো। এই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় কেবল মাঠপর্যায়ের অপরাধীদের নয়, সেসব কমান্ডিং অফিসার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ওপরও বর্তায়, যারা এ ধরনের নির্যাতনের পদ্ধতিকে অনুমোদন অথবা উৎসাহিত করেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।