
তারুণ্যের রক্তস্নাত জুলাই। আন্দোলনের আহতরা বলছেন, ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই আন্দোলন শুরু হলেও মুক্তিকামী মানুষ একে সামগ্রিক রূপ দিয়েছিল নিজেদের প্রয়োজনেই। জুলাইয়ের বর্ষপূর্তিতে গণমানুষের পর্যবেক্ষণ, তারা যতটা চেয়েছিলেন, ততটা হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, গণমানুষের রক্তের দামে রচিত জুলাই ব্যর্থ হলে আবারও স্বৈরাচার নেমে আসতে পারে এই ভূখণ্ডে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার খবরে জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তবে অধীর অপেক্ষার এ মুহূর্তে পৌঁছার অভিযাত্রা সহজ ছিল না। কত তরুণ, কত কিশোরের ক্ষতবিক্ষত লাশ, বুলেট বিঁধে থাকা শরীর, কত আতঙ্কের নির্ঘুম রাত শেষে এক ৫ আগস্ট। ৩৬ জুলাইখ্যাত এই দিনটি কি আসি-আসি করছিলো জুলাইয়ের শুরু থেকেই? শহরের দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবীদের ফেলে যাওয়া স্মৃতিতে, যে তারিখ চিহ্নিত ‘এক বিরাট পরিসমাপ্তির শুরু’ নামেই।
ইট-কাঠের দূষিত বাতাসের শহরে এক টুকরো অবসরখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আড্ডা-খুনসুটির ছায়াঘেরা এ ক্যাম্পাস এ আরেকবার আসলো ইতিহাসের বাক বদলের ডাক। এবং নিঃসন্দেহে এটার শুরু, কোটা সংস্কার আন্দোলন নামেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জসিমউদ্দিন খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে লিড দিচ্ছে বা তারা আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে সেভাবে আন্দোলন হচ্ছে তা না। আমরা যার যার মতো করে রাস্তায় নামছি। আমাদের ১৪ তারিখ পর্যন্ত এটা আন্দোলন ছিল শুধু কোটা নিয়ে। ১৪ তারিখের পর যখন আমাদের রাজাকার ট্যাগ দিলো, তখন আমাদের মধ্যে একটা ক্ষোভ তৈরি হলো যে আমরা কেন রাজাকার এখানে। আমরা তো যৌক্তিক আন্দোলন করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্পিতা বলেন, ‘সত্য কথা বলতে ১৫ জুলাই আসলে আমরা এগুলো ভাবিনি যে বাইরে থেকে মানুষ এনে আমাদের আহত করা হবে। আমাদের ভাইবোনরা আমাদের মারবে। তখন আমাদের ভেতর একটা জিনিসই ছিল যে, আমাদের ভাইরা যখন মারা গেছে তখন তো এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কার আন্দোলন থাকে না। যারা শহীদ হয়েছেন আমার মনে হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বললে শহীদদের অপমান করা হয়।’
মূলত এই জুলাই অভ্যুত্থান বিপুল আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে জনতার মনে। তারা এখন এই দেশের আমুল পরিবর্তন চায়। তারা আশা করেছিল, রক্তের দামে কেনা স্বৈরাচার পতনের এই অভূতপূর্ব ঘটনা, সেবা, রাজনীতি কিংবা সরকার, মানুষের অধিকারের পক্ষে বিরটা একটা পরিবর্তন আনবে। কিন্তু হয়েছে কতটা?
নাগরিকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘চলমান সরকার এটাকে নতুন বাংলাদেশ বলছে। কিন্তু আমি নাগরিক হিসেবে বলবো যে, খুব বেশি প্রাপ্তি আমাদের নেই।’
অন্য একজন বলেন, ‘সবখাতে পরিবর্তন আসেনি। কিছু খাতে পরিবর্তন আসছে।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘শুরুতে যেটা ভেবেছিলাম যে, অনেক পরিবর্তন আসবে। আন্দোলন শেষ হওয়ার পর আস্তে আস্তে তো দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন দলের মধ্যে মতবিভেদ চলছে।’
এটা ঠিক, গণঅভ্যুত্থানের মতো একটা বড় পট পরিবর্তনের পর সবক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনা সহজ ব্যাপার নয়। রাষ্ট্র পুনর্গঠন পক্রিয়ায় রপ্তানি ও রিজার্ভ বাড়ানো, বিভিন্ন সরকারি সেবা ও প্রকল্পে অর্থ সাশ্রয় করা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার মত যেসব অন্তর্নিহিত নীতি সংক্রান্ত উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার, সরাসরি তার সুফল এখনই জনগণ পাচ্ছে না। তবে দৃশ্যমান উদ্যোগের মধ্যে আছে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি পাল্টানো এবং গণহত্যার বিচার শুরু।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক এবং নবগঠিত এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, যিনি আবার সরকারেও ছিলেন, তার কাছে এখন টিভি প্রশ্ন করেছিল অভ্যুত্থানের এক বছরের মূল্যায়ন সম্পর্কে?
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বাস্তবতা ভিন্ন, একটা গণঅভ্যুত্থানের পর একটা ১৫-১৬ বছরের সব ময়লা পরিষ্কার করার দায়িত্ব একটা সরকারের এক বছরের মধ্যে। তারপরও তার রাজনৈতিক সমর্থন, সেই অর্থে দলের সমর্থন নেই। সে একেবারেই সাধারণ মানুষের সমর্থনে আছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা তো আমাদেরও ছিল। সেটা সরকারের বাস্তবায়নের জায়গা থেকে অনেক জায়গায় অপ্রাপ্তি রয়েছে বলে তো আমরা এটা স্বীকার করবোই অবশ্যই।’
বাস্তবতা হলো, গণঅভ্যুত্থানের পর গেল এক বছর ধরে পতিত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। এ কারণে শঙ্কাও তৈরি হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও নির্বাচন নিয়েও। তাহলে ভবিষ্যৎ কী?
রাজনীতি বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘এই অভ্যুত্থানে মানুষ যেভাবে অকাতরে জীবন দিয়েছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা। এত কষ্ট লাগে। অনেকে যে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, এদের প্রতি কি আমাদের দায়িত্ব নেই? আমাদের দেশের লোকরা আসলে যারা এলিট, তারা ভীষণ স্বার্থপর। এবার প্রতারিত হলে বাংলাদেশে হয় একটা খুব রক্তক্ষয়ী কিছু হবে, অথবা এটা বহু দিনের জন্য থেমে যাবে। কারণ মানুষ রাস্তায় নামতে চাইবে না তো। কেন আমি মারা যাবো? কীসের জন্য? ওই স্পিরিটটা চলে যাবে মানুষের।’
এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের দায়মুক্তি ও চেতনা সংবিধানে সংস্থাপন না করতে পারলে ব্যর্থ হবে গণমানুষের ত্যাগ। তিনি এও বলছেন, সংস্কার ও রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে জুলাই অভ্যুত্থানকে অন্তর্ভুক্ত না করায়, নিরাপত্তা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সব শ্রেণির মানুষের।