Image description
 

আমাদের নদীগুলো এখন ময়লার ভাগাড়। নদীর পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ভাগাভাগির প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু নদী বেঁচে থাকতে হলে নিজস্ব যে পানি দরকার, সেটা কে দেবে? নদীকে তো সাগর পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।’

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ দূষণ, নদীদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্যের আধিক্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানান পরিবেশগত সংকট নিয়ে কথা বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের পরিবেশগত ঝুঁকির বর্তমান চিত্র কেমন?

গওহার নঈম: আমরা পরিবেশগত ঝুঁকির গহ্বরে চলে গেছি। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুব কম। সবকিছু এখন দূষিত। যেহেতু এবারের স্লোগান প্লাস্টিক নিয়ে, তাই পলিথিন আর প্লাস্টিক নিয়েই বলছি। রাস্তা-ঘাটে প্লাস্টিক ফেলে আমরা অভিযোগ করছি, রাস্তায় কেন পানি জমছে। প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে শক্ত পদক্ষেপ জরুরি।

এটা নিয়ে বড় ধরনের আলোচনা দরকার। এটার আলোচনা ছাড়া পরিবেশ উপেক্ষিত থেকে যায়। এখন সরকারি মিটিংয়ে প্লাস্টিকের বোতল নেই। তারা বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছে। একইভাবে বাজারে গেলে নিজেই পলিথিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে যেতে হবে। না হলে এটা বন্ধ হবে না। একসময় যখন পলিথিন ছিল না, তখন মানুষ ঠিকই পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতো।

ঢাকায় জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পলিথিন-প্লাস্টিক। এগুলো আমাদের কর্মফল। আমরা বাইরে না ফেললে তো সেটা ড্রেনে যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের যে দোষ, তার চেয়ে বেশি দোষ আমাদের। আমাদের ভোগ বেড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি প্রভাব ফেলছে।

নদী মেরে ফেলে পরিবেশ আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভেবে লাভ নেই। নদী মানে শুধু মাছ আর পানি নয়। হাজার হাজার কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র্য নদীতে বসবাস করে। নদী একটা জীবন। তার ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার প্রাণী ও লাখ লাখ মানুষের জীবিকা। দেশকে বাঁচাতে হলে, নদীকে বাঁচাতে হবে

জনগণ যদি প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ না করে, অন্য কিছু দিয়ে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। মানুষকে যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করা যায়, যে ব্যবহার করবে না, তাহলে সম্ভব। মানুষকে ছোটবেলা থেকে শেখাতে হবে। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

জাগো নিউজ: দেশের বর্তমান নদীগুলো নিয়ে কী ভাবছেন?

গওহার নঈম: আমাদের নদীগুলো এখন ময়লার ভাগাড়। নদীর পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ভাগাভাগির প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু নদী বেঁচে থাকতে হলে নিজস্ব যে পানি দরকার, সেটা কে দেবে? নদীকে তো সাগর পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। রাজশাহীতে ফারাক্কা দিয়ে ভারত পানি উঠাচ্ছে, আর যেটুকু পানি আছে, সেটা আমরা উঠাচ্ছি রাজশাহীর মানুষের পানি সরবরাহ করার জন্য।

 

রাজশাহীতে একেকটা প্রকল্প হচ্ছে, যার আওতায় প্রতিদিন ২০ হাজার কোটি লিটার পানি তোলা হবে মানুষের ব্যবহারের জন্য। এই পদ্মায় যদি পানি না থাকে, তাহলে মধুমতি নদী থাকবে না। আবার মধুমতিতে পানি না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না। কিন্তু এসব নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এখন নদীর অধিকার রক্ষাটা জরুরি। না হলে পরিবেশ বাঁচানো যাবে না।

জাগো নিউজ: নদীতে প্লাস্টিক দূষণ দিন দিন বাড়ছে, আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

গওহার নঈম: নদী মেরে ফেলে পরিবেশ আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভেবে লাভ নেই। নদী মানে শুধু মাছ আর পানি নয়। হাজার হাজার কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র্য নদীতে বসবাস করে। নদী একটা জীবন। তার ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার প্রাণী ও লাখ লাখ মানুষের জীবিকা। দেশকে বাঁচাতে হলে, নদী বাঁচাতে হবে। নদী প্লাস্টিকের শরীর হয়ে গেছে। এই শহরে-নগরে ফেলা প্রতিটি প্লাস্টিকের শেষ গন্তব্য নদী।

আমাদের বন বিভাগ জানেই না, হাতি গর্ভবতী হলে সে সমতলে আসবে। সে তখন পাহাড়ে বাঁচতে পারে না। চট্টগ্রামে যতগুলো হাতি মারা গেছে, অধিকাংশই গর্ভবতী। আমরা তো তাদের জন্য বিকল্প রাখিনি, তাদের আবাসস্থল আমরা নষ্ট করেছি উন্নয়নের নামে

আমরা শহরের মানুষরা আসলে শহরটাকে ‘ওউন’ করি না। না হলে দেশের মানুষ যখন ইউরোপ কিংবা সিঙ্গাপুর যায়, তখন সে বাইরে থুথু ফেলছে না, প্লাস্টিক নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলছে। দেশে এসে কিন্তু ঠিকই সে জায়গায় বেজায়গায় ফেলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এটা থেকে না বের হতে পারবো, ততক্ষণ এই প্লাস্টিক-পলিথিন নদীতে যাবেই।

জাগো নিউজ: দেশে পরিবেশের ভারসাম্য খুবই কম। দুর্যোগের অব্যবস্থাপনা এর জন্য কতটুকু দায়ী

গওহার নঈম: বন উজাড়, নদী দখল ও শিল্পবর্জ্যে দূষণের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। ফল বন্যা, খরা ও অতিবৃষ্টির দুর্যোগ ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। আবার এসব দুর্যোগ পরিবেশের ওপর আঘাত হানে, বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, নদীভাঙন ও পানিদূষণ হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা ও নদীভাঙন ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা পরিবেশ সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই পরিবেশ রক্ষায় দুর্যোগ মোকাবিলাটা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হতে হবে।

জাগো নিউজ: অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে অনেক সময় পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে—আপনি কীভাবে এ বিষয়টি মূল্যায়ন করেন?

গওহার নঈম: এক্ষেত্রে আমার মন্তব্য হলো—আমাদের নিয়ত ঠিক নেই। আমরাই চাচ্ছি না। অপরিকল্পিত ব্রিজ হচ্ছে, রাস্তা হচ্ছে। পরিবেশের কথা চিন্তা না করেই বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সরকার চায় বড় বড় অবকাঠামো হবে, টাকা-পয়সা আয় হবে। কন্ট্রাক্টররা, রাজনৈতিক নেতারা চান তাদের আয় বাড়বে। এভাবেই চলছে।

সম্প্রতি হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। আমাদের বন বিভাগ জানেই না, হাতি গর্ভবতী হলে সে সমতলে আসবে। সে তখন পাহাড়ে বাঁচতে পারে না। চট্টগ্রামে যতগুলো হাতি মারা গেছে, অধিকাংশই গর্ভবতী। আমরা তো তাদের জন্য বিকল্প রাখিনি, তাদের আবাসস্থল আমরা নষ্ট করেছি উন্নয়নের নামে।

জাগো নিউজ: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কোন দিকগুলোতে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার?

গওহার নঈম: দুর্যোগ এলে আমরা সিগন্যাল দেই। আমাদের সিগন্যাল তৈরি হচ্ছে শুধু জাহাজ আর নৌবন্দরের জন্য। আমরা এখনো এসব নিয়ে পড়ে আছি। সিগন্যাল হওয়া উচিত শুধু তিনটি। সাধারণ মানুষ এত সিগন্যাল বোঝে না। তাদের বলতে হবে কোথায় কত ফুট পানি উঠবে, কখন উঠবে? কতটুকু বৃষ্টি হলে কতটুকু পানি উঠবে এটা কৃষককে জানাতে হবে। আমাদের আবহাওয়া অফিস প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অথচ এটার কাজ করা উচিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে। এই দুই জায়গায় সমন্বয় করতে হবে।

আমাদের জন্য সুন্দরবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সুন্দরবন বন্ধ ঘোষণা করে, কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মনে করা হয়, এটা সুন্দরবনের জন্য ভালো। আমাদের বোঝা উচিত, আমাদের যেমন সুন্দরবন লাগবে, তেমন সুন্দরবন মানুষের প্রয়োজন

লবণাক্ততা বেড়ে গেছে বলে আমরা লবণ সহনীয় ধান আবিষ্কার করেছি। কিন্তু সেই ধানে আমরা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাই না। যেটা আমরা মিষ্টি পানিতে পাই। এই জিনিস নিয়ে আমাদের কোনো গবেষণা নেই। তাহলে আমরা কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করবো?

আমাদের জন্য সুন্দরবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সুন্দরবন বন্ধ ঘোষণা করে, কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মনে করা হয়, এটা সুন্দরবনের জন্য ভালো। আমাদের বোঝা উচিত, আমাদের যেমন সুন্দরবন লাগবে, তেমন সুন্দরবন মানুষের প্রয়োজন।

সুন্দরবনে গোলপাতা কয়েকদিন পর কেটে না দেওয়া হলে গোলপাতা আর জন্মায় না, মারা যায়। সুন্দরবনে এখন গোলপাতার বন ধ্বংসের পর্যায়ে। এই গোলপাতা ওই অঞ্চলের মানুষের ঘর বানানোর অন্যতম উপকরণ। এই পাতা না পেয়ে বহু মানুষ সিমেন্টের টিন ব্যবহার করছে, সেই টিনে অ্যাসবেসটস রয়েছে। বৃষ্টি হলে এই টিনের পানি আমরা খাচ্ছি, ব্যবহার করছি গৃহস্থালি কাজে। আর ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছি। দক্ষিণাঞ্চলে ক্যানসারের রোগী বেড়ে গেছে। এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না।

জাগো নিউজ: পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতিমালাগুলো কতটা বাস্তবমুখী?

গওহার নঈম: একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। সবশেষ নিম্নচাপের ফলে সাগরে উচ্চ জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। জোয়ারের পানি ঢুকে কী ক্ষতি হয়েছে সবাই জানে। এই জোয়ারের উচ্চতা কত ফুট হবে, এগুলো ২০ দিন আগে কিন্তু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার কেন প্রস্তুতি নিতে পারেনি? সে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভালো, যে দেশে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী। তাই নীতিগত জায়গায় ইউনিয়ন পরিষদকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব নীতিগত জায়গায় পরিবর্তন আনা উচিত।

উপকূলীয় এলাকায় শুধু সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু এসব শেল্টারে মানুষের দুর্ভোগ অনেক বেশি। দুই স্কয়ার ফুট জায়গায় একটা মানুষ কীভাবে গাদাগাদি করে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা থাকবে? একটা শেল্টারের টাকা দিয়ে ৩৫টি বাড়ি বানানো যায়, যেগুলো অধিকতর টেকসই হয়। সেটা না করে এমন বাড়ি বানানো উচিত, যেন মানুষকে দুর্যোগের সময় তার বাড়ি ছাড়তে না হয়।

ভালো পরিবেশ গড়তে হলে জবাবদিহিতা খুবই জরুরি। জবাবদিহিতা ছাড়া ভালো পরিবেশ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারী, বসবাসকারী সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের কোন কোন এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে?

গওহার নঈম: পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষও এটার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। আগে ঝুঁকি কম ছিল, কিন্তু এখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, ক্ষতিও বেড়েছে। যে প্রক্রিয়ায় মানুষ পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা করবে, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ভোগান্তিতে আছে। ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ সব উপকূল দিয়েই আঘাত হানছে। মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হলো—জাহাজ ভাঙার ফলে উপকূলীয় অঞ্চল অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙার বর্জ্যসহ অন্য বর্জ্য উপকূলীয় এলাকার কাছের সাগরে পড়ছে। আগে সাগরের ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে যে মাছ পাওয়া যেত, সেই মাছ এখন পাওয়া যাচ্ছে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে।