Image description
♦ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ♦ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে সাধারণ মানুষ ♦ বিনিয়োগকারী ভীত ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে ♦ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ঘুরছে না শিল্পের চাকা ♦ আইনশৃঙ্খলার অবনতি, চলছে মব ভায়োলেন্স ♦ উচ্চ সুদের হার, ব্যাংকে টাকা সংকট

ভালো নেই দেশের মানুষ। শহর থেকে গ্রামে কোথাও স্বস্তি নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ফলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ বেড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ। একের পর এক আন্দোলনে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় অবধি।

ভালো নেই ছোট ও বড় ব্যবসায়ীরাও। গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে ঘুরছে না শিল্প-কারখানার চাকা। ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। বাড়ছে বেকারত্ব। হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অভ্যন্তরীণ সংকটের পাশাপাশি একের পর এক বহিমুখী সংকট ধেয়ে আসছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ট্রানশিপমেন্ট বন্ধের পর স্থলপথে রপ্তানি সুবিধা স্থগিত করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়েছে ট্যারিফ। সুদের হার বেশি থাকায় ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে পারছে না শিল্পোদ্যোক্তারা। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। নজিরবিহীনভাবে মিথ্যা হত্যা মামলার আসামি করা হচ্ছে অনেককে। মব-ভায়োলেন্সে ও ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। অনেক ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। চাঁদা না দিলে অফিস-আদালত এমনকি বাসাবাড়িতেও হামলা চালানো হচ্ছে। এমন কি রাষ্ট্রীয়ভাবেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। বড় ব্যবসায়ী যারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হচ্ছে; হয়রানিমূলক অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকে তলব করা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন কোনো খাত নেই, যে খাতের জন্য সরকার ন্যূনতম প্রশংসার দাবিদার হতে পারে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এক অনুষ্ঠানে বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একদম আইসিইউতে আছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। যদি বিনিয়োগ আইসিইউতে থাকে, তাহলে যে বিনিয়োগকারী, সে তো বিনিয়োগ ফেরত নিতে পারছে না।

সব জায়গায় এখনো বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আয়ের বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, রাজনৈতিক বৈষম্য- সবই বাংলাদেশে দিন দিন বেশি হচ্ছে। সরকারের কার্যক্রম বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু বিষয়ে এখনো আস্থাহীনতা আছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা রয়েছে। এসব নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এখনো মানুষ নির্বাচন নিয়ে যতটা ভাবছে, একই সঙ্গে নিজেদের নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তা নিয়েও তার চেয়ে বেশি ভাবছে।

বিজিএমএইর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস, বিদ্যুৎ- সেটি নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি। শিল্পের জন্য কোথাও কোনো সুখবর নেই। অনেক শিল্পকারখানার মালিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না বুঝতে পারছেন না। এই অবস্থায় দেশীয় শিল্পে সুরক্ষা না দিয়ে বিদেশি শিল্পকে নানা প্রণোদনা দিয়ে ডেকে আনছে সরকার। দেশের শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পুরো শিল্পখাত এখন আইসিইউতে আছে। সঠিক চিকিৎসা ছাড়া এগুলো টিকবে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা নেই। এতে করে বিনিয়োগকারীরা ভীত, ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কে আছেন। স্বাস্থ্যসেবাতেও চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। ভালো নেই জুলাই আন্দোলনের আহতরাও। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। এমন কি আহতদের কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। ভালো নেই দেশের ব্যাংক-বীমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে দিনের পর দিন। ঋণ কার্যক্রম দূরের কথা আমানতকারীদের আমানত দিতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উন্নয়ন অধ্যয়নের শিক্ষক রাশেদ আল তিতুমীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রকৃত মজুরি কমছে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। নতুন করে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে দিকনির্দেশনা নেই। রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা এবং সংস্কারের অভাবে দেশের অর্থনীতি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।

নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের আবাসন খাতেও। নানা অনিশ্চয়তার কারণে নতুন ফ্ল্যাট কেনা বা বাসাবাড়ি করার হার কমে গেছে। আবাসন শিল্পে দেখা দিয়েছে চরম মন্দা। এডিপি কার্যক্রমের পাশাপাশি বড় প্রকল্প বন্ধ থাকায় কমে গেছে রড-সিমেন্টের চাহিদাও। এ অবস্থা চলতে থাকলে চরম সংকটে পড়বে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও জেসিএক্স গ্রুপের কর্ণধার ইকবাল হোসেন চৌধুরী (জুয়েল) বলেন, দেশের এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা রয়েছে। মানুষের ভিতরে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেনাবেচা ও মার্কেটে টাকার প্রবাহ ভীতিকর অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় আরও কিছু মাস চললে ব্যবসাবাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ এবং সব রাজনৈতিক দলগুলোকে সমন্বিত জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করে একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। অন্যথায় আমাদের তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বোনাস দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে যাবে। বাড়বে বোকারত্ব। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসাইন বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চাপে আছে সাধারণ মানুষ। এই চাপ আরও বেড়েছে নানা ধরনের অনিশ্চয়তায়। দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্য কোথাও সুখবর নেই। আউটসোর্সিংয়ের নামে হাজার হাজার শ্রমিকের চাকরি অনিশ্চয়তায় পড়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশন সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, গত কয়েক মাসে অনেক গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। ১ লাখের বেশি বেকার শ্রমিক এখন অসহায় অবস্থায় আছে। সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারছে না। মালিকরা শ্রমিকের বেতন ঠিকমতো দিতে পারছে না। সামনে ঈদ। শ্রমিকরা মে মাসের বেতন পাচ্ছে না। তারা বেতন পাবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই।