
তিস্তা অববাহিকার গড্ডিমারী গ্রামের কৃষক হাফিজুল ইসলাম। তিস্তা পাড়েই তার জন্ম। দিন - মাস -বছর পেরিয়ে এখন তার বয়স ৭০ বছরে ঠেকেছে। ছোট থেকে এই বৃদ্ধ বয়সের অভিজ্ঞতায় তিনি জানালেন "দুই যুগ আগে তিস্তা গভীর ছিল। এখন নদীর বুক আর নদীর পাড় সমান হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় সামান্য পানি এলেই নদীর পানি উপচে পড়ে। উজানের ঢেউ পানির সঙ্গে ভেসে আসে বালুর স্তর। যা জমির উর্বরতা নষ্ট করে দিচ্ছে, ফসল ফলানো যায় না।"
উজান থেকে আসা পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী। নদীর পাড়ের পরিবারগুলো বলছে ১১৫ কিলোমিটার অংশ যেন মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল হয়ে যাচ্ছে। নদীর তলদেশের গভীরতা কমে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যা বর্ষাকালে সামান্য পানিতেই উপচে পড়ে নদীর দুকূল, দেখা দেয় বন্যা।
অনেকে বলেন, তিস্তা নদীর ভাঙাগড়া নিয়ে শতশত কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কিন্তু কখনও নদী খনন করা হয়নি। ফলে দেশের দরিদ্রতম রংপুর বিভাগের নীলফামারী,লালমনিরহাট,রংপুর,কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলাগুলোর পাঁচটিই রয়েছে সর্বনাশা তিস্তা জুড়ে। এখানকার লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম এই নদী। এই পাঁচ জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল।২৩৭ বছর বয়সী তিস্তার প্রবাহ এই পাঁচ জেলার বুক চিরে প্রতিবছরই ডেকে আনছে বন্যা ও খরা। এতে মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভারী হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে দুই পাড়ের জীবনচক্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছেন , প্রতি বছর বর্ষার সময় উজানে ভারত থেকে প্রায় দুই কোটি টন পলি তিস্তার পানির সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এই পলির কারণে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। কখনোই তিস্তা খনন না করায় গত কয়েক বছরে তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার মান চারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে।
তিস্তার চরবাসীরা জানায়, এইতো গত কয়েকদিনে উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে তিস্তা নদীতে। পানির চাপ বেশি থাকায় ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এতে করে চর এলাকা তলিয়ে যায়। আর ঘোলাটে পানির স্রোত ধেয়ে যেতে থাকে ভাটির দিকে। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি আসায় তিস্তা নদীর বুক ভরাট হয়ে এসেছে। ফলে প্রতিবছর নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। বিদ্যমান চরগুলো আরও উঁচু হচ্ছে। পলিতে নদীর বুক উঁচু হওয়ায় স্বল্প পানিতেই নদী টইটম্বুর হয়। পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। পথঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সোমবার (২ মে) সন্ধ্যায় তিস্তার পানি প্রবাহ ডালিয়া পয়েন্টে ছিল বিপৎসীমার (৫২.১৫) দশমিক ৪৭সেন্টিমিটার (৫১.৬৮) নিচে ও কাউনিয়া পয়েন্টে ছিল বিপৎসীমার (২৯.৩১) দশমিক ৩৬ সেন্টিমিটার (২৮.৯৫) নিচে। তবুও নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দেখলে মনে হবে ভয়াবহ বন্যার সৃস্টি করছে। কারণ নদীর তলদেশ পলিতে ভরাট।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নে তিস্তা নদী একাধিক চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীশাসন, ড্রেজিং না হওয়ায় প্রতিবছর নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বাড়ছে। মহিপুর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এখন ভরা যৌবনে ফিরেছে তিস্তা নদী। প্রবল বেগে নদীর পানি বয়ে চলেছে। ঘোলা পানির কারণে বোঝা যাচ্ছে উজান থেকে পলি বয়ে আনছে তিস্তা।
আসিফ মিয়া বলেন," এই যে দেখছেন তিস্তার পানি, সব কিন্তু ঘোলা। মানে নদীর পানির সাথে অনেক মাটিও আসছে। শুকানোর সময় এই মাটি দেখা যায়। নদী তো মাটিতে ভরে গেছে। আমরা নদীর মাঝে সেই মাটিতে আবাদ করি। নদী ভরাট হয়ে গেছে, সেই জন্যে অল্প একটু পানিতেই আমরা ভেসে যাই। "
ধীরেন্দ্র নাথ বলেন, "আগে তো নদী অনেক গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এখন তো গভীরতা নাই। শুকানোর দিনে তো মানুষ হাঁটি নদী পার হয়। নদী পার হয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করি আমরা বাড়িতে ফসল নিয়া যাই।"
আমিনা বেগম বলেন," নদীতে পানি বাড়লে, আমরা বাঁধে দিন-রাত কাটাই। আবার পরের দিন পানি কমে গেলে বাড়িতে উঠি। আবার দেখা যায় রাতে ভারত পানি ছেড়ে দেয়। বৃষ্টির দিনে তো আমাদের দৌড়াদৌড়ির উপর থাকা লাগে।"
নদী রাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, "১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৭ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোনো পরিচর্যা করা হয়নি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ যুগের কোনো সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ তিস্তা নদীর সুরা অত্যন্ত প্রয়োজন।এখন আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নদী ড্রেজিং করতে হবে।"
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, "প্রাথমিকভাবে বলা যায় উজানের ঢলে বর্ষাকালে তিস্তা নদীতে বছরে দুই কোটি মেট্রিকটন পলি এসে জমাট বাধে। ফলে নদীটি ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে, তবে শুষ্ক মৌসুমে এ পরিমাণ পানি থাকে না। বর্ষায় এই প্রবাহ বেড়ে চার লাখ কিউসেক ছাড়িয়ে যায়। তখন নদীর পানি উপচে সমতলে প্রবেশ করতে থাকে। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে" বলে তিনি যোগ করেন।