
পরবর্তীতে তাদের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষমতায় থাকা সরকারকে বিপাকেও পড়তে হত। সর্বশেষ নানা বির্তকের মুখে সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার।
এ অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে সরে এসে সার্চ কমিটির মাধ্যমে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে শিক্ষা উপদেষ্টাকে। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) দুজন সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য এবং মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবও থাকবেন।
যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঢামাঢোল এড়াতে ১৬ বছর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সেসময় বলা হয়েছিল, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে। পরে অবশ্যই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই কমিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যমতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও গবেষণা-প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার মাপকাঠির কোনো সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক নেই। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরের নিজ নিজ আইনে বিধান রয়েছে যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পাবেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনির্বাচিত উপাচার্যরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করেছেন।
আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কোনো মানদণ্ডই নেই। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি উপাচার্য নিয়োগ দিলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা পাঠানোর পর প্রধান উপদেষ্টা (প্রধানমন্ত্রী) সম্মতিক্রমে তিনি তা করে থাকেন।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘উপাচার্যরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। তাদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সরকারকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। যোগ্য এবং সৎ ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ সার্চ কমিটিই করবে।’
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘সার্চ কমিটি গঠনের সার সংক্ষেপ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটিতে শিক্ষা উপদেষ্টা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের রয়েছেন। কমিটিতে থাকা ইউজিসির আরেক সদস্যের নাম জানাতে পারেনি সূত্রটি।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি। বাকি ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরা পদত্যাগ করেন। পরে ১৬ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনে ভিসি নিয়োগের মতো গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সেক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে পশ্চিমা ডিগ্রি-গবেষণায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের মধ্যে থেকে প্রথম সারিতে থাকা অনেক শিক্ষকও ভিসি হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছেন।
এসব নিয়োগ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানকে বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয় বর্তমান সরকার। তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননাসহ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পাদন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) নতুন ভিসি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তাছাড়া পশ্চিমা ডিগ্রি-গবেষণায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু নিয়োগে বিতর্কিত ও দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। তেমনি একজন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সম্প্রতি তাকে অব্যাহতি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, সার্চ কমিটির মাধ্যমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে তার জায়গায় একজন অন্তর্বর্তী ভিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
এদিকে, কুয়েটের এই ঘটনা যেতে না যেতেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। নিয়োগ পাওয়ার পর তিনিও নানা বির্তকের মুখে পড়েছেন। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ নিয়ে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে ইউজিসির। এ ঘটনায় তাকে অপসারণের সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে ইউজিসি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ যেভাবে হয়?
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে উপাচার্য হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি। কিন্তু দেশে দলীয় সরকারগুলো মূলত পছন্দমতো শিক্ষককে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। ফলে উপাচার্য হওয়ার জন্য একজন শিক্ষকের প্রধান যোগ্যতা হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কিংবা আনুগত্য।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা অধ্যাদেশ-১৯৭৩-এর ১২(১) ধারা অনুযায়ী, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের বিধান হলো, সিনেটররা নির্বাচনের মাধ্যমে তিন জন ব্যক্তির প্যানেল করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন, সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেবেন। একজন উপাচার্য নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী (প্রধান উপদেষ্টা) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত সম্মতি দিলে আদেশ জারি হয় মন্ত্রণালয় থেকে। প্রচলিত নিয়মে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির।
তবে রাষ্ট্রপতি এককভাবে এই নিয়োগ দিতে পারেন না। বিভিন্ন মাধ্যমে আসা নাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব আকারে নথি তৈরি করে। এটা প্রধানমন্ত্রীর (প্রধান উপদেষ্টা) কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বা অন্যান্য পদে কে নিয়োগ পাচ্ছেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর (প্রধান উপদেষ্টা) অভিপ্রায়ের ওপর।