
অডিটে ধরা রাজ্যের আর্থিক অনিয়ম টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্যসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন - জীবিকার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয় । কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে । শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই অডিট অধিদপ্তর এতে ২৫৮ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে । মৎস্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন , এসব অনিয়মে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল প্রকল্প পরিচালকের ।
অডিটের তথ্যমতে , প্রকল্পের বড় আর্থিক অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন ( বিএফডিসি ) ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজে ডিফার্ড বার ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে ঠিকাদারকে ৪৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দেওয়া , খালের মাটি খননের অতিরিক্ত উচ্চতা দেখিয়ে বিল পরিশোধ করার মাধ্যমে সরকারের ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা ক্ষতি করা , অনুমোদন ছাড়া মূল বিশেষজ্ঞ পরিবর্তন করে আরডিপিপি বরাদ্দ থেকে অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় করা , কাজ সম্পাদনের ভুয়া তথ্য দিয়ে ঠিকাদারকে তিন কোটি টাকা আর্থিক সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি । এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় পরামর্শককে বিল পরিশোধ , একই কাজের জন্য দুবার বিল পরিশোধ , আর্থিক বিবরণীতে ৩৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা অতিরিক্তভাবে দেখানোর মতো নানা অনিয়ম করা হয়েছে । সমর্থনযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে ৪৮ কোটি ৫০ হাজার টাকার ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে ।
চিংড়িচাষিদের উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাট প্রকল্পে চিংড়িচাষিদের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অভিযোগ রয়েছে , প্রান্তিক চাষিরা এর ছিটেফোঁটা সুবিধাও পাননি । কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাষিদের নামে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে । বিদেশ থেকে উন্নত জাতের রেণু পোনার আমদানির নামে ভুয়া বিল করে দুই কোটি টাকা হাতিয়েছে একটি চক্র । এ বিষয়ে বঞ্চিত একজন চাষি প্রকল্প পরিচালক মো . জিয়া হায়দার চৌধুরী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন । অভিযোগে বলা হয় , ৫০ হাজার সামুদ্রিক চিংড়ির রেণু রেণু পোনা ( পিপিএল ) আমদানির জন্য কক্সবাজার জেলার নামসর্বস্ব এমকেএ হ্যাচারির সঙ্গে সাড়ে ৫ কোটি টাকার ভুয়া চুক্তি করে মৎস্য অধিদপ্তর । প্রতিষ্ঠানটিকে এ জন্য আড়াই কোটি টাকার বেশি অগ্রিমও দেওয়া হয় । যুক্তরাষ্ট্র অথবা থাইল্যান্ড থেকে রেণু পোনা কেনার কথা থাকলেও এমকেএ হ্যাচারি উপকূল থেকে অবৈধভাবে ধরা রেণু পোনা বিদেশ থেকে আনা বলে চালিয়ে দেয় । দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয় , হ্যাচারিকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেন প্রকল্প পরিচালক ও অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক । অভিযোগটি আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুদক । সাবেক মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান আজকের পত্রিকার প্রশ্নের জবাবে বলেন , প্রচলিত নিয়মেই এমকেএ হ্যাচারিকে টাকা দেওয়া হয়েছে । আর তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন । স্পিডবোট কেনার চার বছর আগে চালক নিয়োগ
প্রকল্পে উপকূলের মাছ ধরার নৌযানগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য কিছু স্পিডবোট কেনার কথা ছিল । তবে স্পিডবোট কেনার দীর্ঘ চার বছর আগে “ রেডিসন ডিজিটাল টেকনোলজিস লিমিটেড ' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৬ জন চালক , ১৬ জন সহকারী এবং ১৬ জন মেকানিক নিয়োগ দেওয়া হয় । দেওয়া হয় । অভিযোগ রয়েছে , নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জনপ্রতি দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে । ২০২০ সালের নভেম্বরে হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চরমোনাইয়ের বাসিন্দা মো . রেদোয়ান খান বলেছেন , তাঁকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে । রেদোয়ানের প্রথম কর্মস্থল কুতুবদিয়ায় কোনো স্পিডবোট না থাকায় তাঁকে দিয়ে পিয়নের কাজ করানো হতো । স্পিডবোটের সহকারী ( ডেকহ্যান্ড ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বরিশাল সদর এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান জানিয়েছেন , তিনিও ধার করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন ।
একাধিক স্পিডবোটচালক অভিযোগ করেছেন , রেডিসন টেকনোলজিস তাঁদের বেতনের অ্যাকাউন্টের চেকবই নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল । এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবু জাফরকে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তাঁর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায় । সম্প্রতি ভারত থেকে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা করে ছয়টি স্পিডবোট কেনা হয়েছে । নৌযানগুলো উচ্চমূল্যে কেনার অভিযোগ উঠেছে । স্পিডবোটের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন , ‘ নিম্নমানের স্পিডবোট উচ্চমূল্য দেখিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন । প্রকৃত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন । প্রকৃত বাজারমূল্য যাচাই করলেই এই চুরি ধরা পড়বে ।
এদিকে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ১০ জন স্পিডবোটচালক , আটজন সহকারী ও আটজন মেকানিককে । গাড়ি ভাড়ায়ও অনিয়ম প্রকল্পের আওতায় চীনের তৈরি ১৬ টি চেরি গাড়ির প্রতিটি মাসে ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়েছে । সরকারি অন্যান্য প্রকল্পে একই গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয় ১ লাখ ৬০ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় । এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকল্পের ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো অভিযোগে বলা হয় , বাড়তি টাকায় গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পেছনে পিডি ও ডিপিডি ( উপপ্রকল্প পরিচালক ) মনীষ কুমার মণ্ডলের ‘ কমিশন - বাণিজ্য ’ রয়েছে । অভিযুক্ত মনীষ কুমার মণ্ডল বলেছেন , দরপত্রের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে । আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না ।
অভিযোগ রয়েছে , গাড়িগুলো ঠিকমতো প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হয় না । ভাড়া করা গাড়ির একটি ( ঢাকা মেট্রো - ঘ - ২১-৮৬৪৬ ) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব অঞ্জন কুমার সরকার নিয়মিত ব্যবহার করেন । তিনি বলেন , এই গাড়ি মৎস্য অধিদপ্তরের , তা ঠিক আছে ; তবে এই প্রকল্পের নয় । আরও অন্তত চারটি গাড়ি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে ।
অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে প্রকল্প পরিচালক ( পিডি ) মো . জিয়া হায়দার চৌধুরীকে কয়েক দিন একাধিকবার কল ও মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি । পরে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প দপ্তরে গিয়ে জানা যায় , তিনি ওমরাহ হজ পালনের প্রস্তুতির কারণে অফিসে আসেননি । তবে ভারপ্রাপ্ত পিডি উপপ্রকল্প পরিচালক বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন , অভিযোগের বিষয়গুলো সত্য নয় । একটি পক্ষ বিশেষ উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে । মে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড . মো . আবদুর রউফকে ফোন করলে তিনি বলেন , অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নেবেন । হালনাগাদ তথ্য জানতে এক সপ্তাহ পরে আবার ফোন করা হলে মহাপরিচালক জানান , ব্যস্ততার কারণে খোঁজ নিতে পারেননি । প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন , ‘ এসব বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই । জেনে পরে কথা বলব ।”