
মা-বাবার সংসারে উপার্জনক্ষম ছেলে ছিলেন শহীদ সোহেল রানা। গার্মেন্টসে চাকরি করে আয় যা হতো, তা থেকে বড় একটা অংশ পাঠিয়ে দিতেন পরিবারের জন্য। তাতে ঘর তো চলতই, চলত তার বোনের পড়াশোনা। কিন্তু ঘরের আলো সোহেল শহীদ হওয়ার পর পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। মাকে নিরাপদ থাকার কথা বলে নিজেই হারিয়ে গেলেন চিরতরে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নাটোরের চলনবিলে সিংড়া উপজেলার শোয়াইড় গ্রামের মতলেব আলী প্রামাণিক ও রেহেনা বেগম দম্পতির ছেলে সোহেল । দুই ছেলে আর এক মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার ব্যয় নির্বাহ করতেই দিশাহারা মতলেব প্রামাণিক। জমিজমা নেই, তাই বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে কৃষি শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ায় সে কাজেও আর যেতে পারেন না। ফলে একটি মসজিদে সামান্য বেতনে মুয়াজ্জিনের চাকরি নেন। অন্যদিকে সোহেল নওগাঁর একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করার জন্য। অভাবের সংসার হওয়ায় পড়াশোনার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ডিপ্লোমা শেষ করা হয়নি তার। যোগ দেন ঢাকার একটি গার্মেন্টসে অপারেটর পদে। এরপর সাভারের বাইপাইলে অন্য একটি গার্মেন্টসে পদোন্নতি পেয়ে হন সুপারভাইজার। পেতেন ভালো বেতন। মাসে মাসে বাড়িতে পাঠাতেন ১০ হাজার টাকা। তার পাঠানো টাকায় ভালোভাবেই চলছিল সংসার এবং আদরের ছোট্ট বোন মিমের পড়াশোনা।
কিন্তু সংসারের সুদিন বেশি দিন টিকল না। ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাইপাইল থানার সামনে সোহেল তার ভাড়াবাসার চারতলায় গুলিবিদ্ধ হন। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে।
সোহেলকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তার চাচা জাহিদ হোসেন বলেন, পুলিশের ছোড়া গুলিতে সোহেল রাত ৯টার দিকে মারা যায়। আমরা তো সোহেলকে আর ফিরে পাব না। ওর রক্তে ভেজা বাংলাদেশ যেন ভবিষ্যতে সবার জন্য নিরাপদ হয় আর যেন রক্ত না ঝরে।
গত বছর কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসাই ছিল সোহেলের শেষ আসা। এরপর ৬ আগস্ট সকালে নিথর দেহ বাড়িতে পৌঁছায়। বাদ জোহর সোয়াইড় মাদরাসা ময়দানে হাজারো মুসল্লি জানাজার নামাজে সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে বিদায় জানান সোহেলকে। কেন্দ্রীয় গোরস্থানে শহীদ সোহেল এখন চিরনিদ্রায় শায়িত।
বড়ভাই সাদ্দাম হোসেন বলেন, সোহেল মনের সব কথা উজার করে বলত। সব সময় আমার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলত। ও খুব প্রাণখোলা মানুষ ছিল।
মা রেহেনা বেগম বলেন, ৫ তারিখ বেলা ১১টার দিকে সর্বশেষ আমার সঙ্গে কথা বলে সোহেল। বলে, এখানে খুব গন্ডগোল-গোলাগুলি হচ্ছে, দেশের অবস্থা ভালো না, তোমরা সাবধানে থেকো। আমাদের নিরাপদ থাকার কথা বলে আমার সোহেল হারিয়ে গেল চিরতরে।
বাবা মতলেব আলী প্রামাণিক বলেন, সংসারের হাল ধরা ছেলেকে হারিয়ে আজ আমরা দিশাহারা। সংসারের নিয়মিত ব্যয় নির্বাহসহ মেয়েটার পড়াশোনা ও বিয়ে অনিশ্চিত হয়ে গেল। তিনি জানান, তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন দিয়েছে ৫০ হাজার টাকার অনুদান।
সাবেক এমপি এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ বলেন, দলের পক্ষ থেকে শহীদ সোহেল রানার পাশে থাকব আমরা।