
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন বিপ্লব হাসান। গত বছরের ২০ জুলাই শহীদ হন ১৯ বছর বয়সি এই তরুণ। উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া বাজারের চূড়ালী গ্রামের বাসিন্দা বিপ্লব বাবুল মিয়া ও বিলকিছ বেগমের একমাত্র ছেলে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ২০ জুলাই স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘোষিত কারফিও অমান্য করে রাজপথে নামে গৌরীপুরের ছাত্র-জনতা। ওইদিন ভোর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিলে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজার এলাকায় জড়ো হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা।
বিক্ষোভে অংশ নিতে সকালবেলায় মায়ের কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে নাশতা খাওয়ার কথা বলে কলতাপাড়া বাজারে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন বিপ্লব হাসান। তখন ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল ছিল কলতাপাড়া বাজার এলাকা।
বেলা ১১টার দিকে গৌরীপুর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন চন্দ্র রায় ও এসআই শফিকুল আলমের নেতৃত্বে একদল পুলিশ কয়েকটি গাড়িতে সাইরেন বাজিয়ে হাজির হয় ঘটনাস্থলে। এ সময় ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সহাসড়কে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় পুলিশ। সেই গুলিতে বিপ্লব হাসান ছাড়াও নূরে আলম রাকিব ও জুবায়ের আহমেদ নামের আরো দুজন মারা যান। আহত হন অন্তত ৬০ জন আন্দোলনকারী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের অতর্কিত হামলায় প্রথমে পিছু হটলেও মুহূর্তেই ইটপাটকেল হাতে ‘যুদ্ধ হবে’ স্লোগানে রুখে দাঁড়ায় আন্দোলনকারীরা। ঘণ্টাব্যাপী পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর মারমুখী পুলিশ হঠাৎ মহাসড়ক থেকে গৌরীপুর-কলতাপাড়া সড়কে সরে যায়। এ সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের সঙ্গে থাকা গুলির মজুত শেষ। আরো গুলি আনতে থানায় গেছে পুলিশের কয়েকজন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার সাহসিকতায় ভীত হয়ে ওসি সুমন চন্দ্র রায় এক পথচারীর মোবাইল ফোনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোমনাথ সাহার সহযোগিতা চায়। পরে গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোমনাথ সাহার নেতৃত্বে আওয়ামী, যুব ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা সেখানে জড়ো হয়।
তখন বেলা প্রায় ২টা। গৌরীপুর-কলতাপাড়া সড়কের একদিকে পুলিশ-আওয়ামী লীগের মুহুর্মুহু গুলি, অন্যদিকে লাঠি হাতে ইটপাটকেল মেরে প্রতিহতের চেষ্টা ছাত্র-জনতার। এরই মধ্যে পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা, সব মিলিয়ে কলতাপাড়া বাজার যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা। এ সময় পুলিশ-আওয়ামী লীগের গুলিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার বহু আহত হওয়ার পাশাপাশি বিপ্লব শহীদ হন। খবর আসে পুলিশের গুলিতে সড়কে পড়ে আছে তার নিথর দেহ। ছেলের খোঁজে মহাসড়কে ছুটে আসেন মা বিলকিছ বেগম। ছেলে হারানোর শোকে পাগলপ্রায় মায়ের আহাজারিতে কলতাপাড়া এলাকার বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা বিল্লাল মিয়া দৈনিক আমার দেশকে বলেন, একজন সক্রিয় সহযোদ্ধা হিসেবে বিপ্লব হাসান ওইদিন সকাল থেকেই মিছিলের অগ্রভাগে ছিল। বেলা ২টার দিকে সোমনাথ সাহার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দিলে পুলিশের এসআই শফিকুল আলম খুব কাছে থেকে বিপ্লব হাসানকে টার্গেট করে গুলি করে। এতে গৌরীপুর-কলতাপাড়া সড়কের ডেলটা মিলসংলগ্ন মসজিদের কাছাকাছি সড়কে লুটিয়ে পড়েন বিপ্লব।
বিল্লাল মিয়া, ‘এ সময় আমরা কয়েকজন এগিয়ে গেলে পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে গুলি চালায়। এতে আমরা পেছনে সরে আসি, তখন এসআই শফিকুল এগিয়ে এসে সড়কে পড়ে থাকা বিপ্লবের মাথায় পরপর আরো দুটি গুলি করে। এর একটি বিপ্লবের মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে যায়। পরে এসআই শফিক দম্ভ করে বলেÑ ‘এবার লাশ নিয়ে যা’।
বাবা মো. বাবুল মিয়া বলেন, আমার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে বিপ্লব। সে ছিল সবার বড়। স্থানীয় হাজি মোজাফফর আলী ফকির উচ্চবিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তিনি বলেন, ‘ছেলে আমার দেশের জন্যে জীবন দিলেও পুলিশের চাপে ছেলের শান্তিপূর্ণ জানাজা দিতে পারিনি। বাড়ির পাশেই বিপ্লবের লাশ কবর দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলের জানাজার পর প্রতিদিনই বাড়িতে পুলিশ আইতো, পুলিশের ডরে বাড়ি ছাইড়া আমি দিন-রাইত বাইরে থাকতাম।’
এ সময় আক্ষেপ জানিয়ে বাবুল মিয়া বলেন, ‘হাসিনা সরকারের পতন না অইলে মনে হয় ছেলের আন্দোলন করার কারণে আমার বাকি জীবন জেলেই থাকতে অইত।’
এ সময় হতাহতের স্মরণে গৌরীপুরের কলতাপাড়া মোড়ে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি চত্বর’ নির্মাণের দাবি জানান বাবুল মিয়া।