
আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য এদেশেরে সূর্য সন্তানদের প্রাণ দিতে হয়েছে, এ ইতিহাস কারো অজানা নয়। শিল্প, সাহিত্য, নাটক সব কিছুতেই একুশে ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সিনেমা নির্মাণও হয়েছে কয়েকটি। এর মধ্যে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ শ্রেষ্ঠতম।
ভাষা আন্দোলনের সিনেমা নিয়ে কথা উঠলেই ‘জীবন থেকে নেয়া’র কথা সর্বাগ্রে উঠে আসে। সিনেমাটি যখন নির্মাণ ও মুক্তি পায় তখন বর্তমান বাংলাদেশ জন্ম লাভ করেনি। অর্থাৎ, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এটি মুক্তি পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান।
‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটিতে নির্মাণ ও অভিনয়ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র অভিনেত্রী সুচন্দা জীবিত রয়েছেন। এটিতে অভিনয়ের অনেক স্মৃতি এখনো তার চোখের সামনে ভাসে।
একবার এক সাক্ষাৎকারে সুচন্দা ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটিতে অভিনয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে একটা কাজে গিয়েছিলাম। আমি জহিরকে বললাম, “চলো একটা সিনেমা দেখি।” জহির রাজি হলো। আমরা অপেক্ষা করছি শো শুরুর। জহির একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে আর পায়চারি করছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘এত কী টেনশন করছ?’ ও বলল, ‘ভাবছি এমন একটা সিনেমা বানাব, যেটা পুরো পাকিস্তানে ধাক্কা দেবে। পাকিস্তানিদের একটা শিক্ষা দিতে হবে।’
সিনেমা দেখে জহির-সুচন্দা দম্পতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরেছেন। একদিন রাতে জহির রায়হান ঘুম থেকে জেগে সুচন্দাকে ডেকে তুললেন। সেই স্মৃতির পাতা উল্টে সুচন্দা জানান, ঘুম থেকে জেগেই জহির তাকে কাগজ-কলম নিতে বললেন। ঘুম ঘুম চোখে সুচন্দা জহির রায়হানের কথা মতো কিছু নোট নিলেন। এতেই ছিল ‘জীবন থেকে নেয়া’ তৈরির প্রথম পাঠ।
‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচন্দা। তিনি তখন গর্ভবতী ছিলেন। সিনেমাটি করতে চাননি এ অভিনেত্রী। এ প্রসঙ্গে সুচন্দা বলেন, ‘জহিরের কথায় রাজি হলাম। ও প্রচণ্ড সাহসী ছিল। শুটিং করছি, একদিন আর্মি চলে এলো। ওকে নিয়ে যাবে ক্যান্টনমেন্টে। আমরা সবাই হইচই শুরু করে দিলাম। জহির তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। একসময় বলল, ‘চলেন।’ কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এলো। বললো, ‘শুটিং শুরু করো।’ পরে জেনেছি, ওরা নাকি বলছে, ‘আপনি এই সিনেমা বানাতে পারেন না।’
আর্মিদের এমন কথায় জহির রায়হান বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড আছে, তারা নির্ধারণ করবে, এই সিনেমা মুক্তি দেওয়া যাবে কি না। আপনারা তো শুটিং আটকাতে পারেন না।’
‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটিতে আরও অভিনয় করেছেন, ‘নায়ক রাজ রাজ্জাক রাজ্জাক’, ‘ফারুক’, ‘আনোয়ার হোসেন’, ‘শওকত আকবর’, ‘রোজী সামাদ’, ‘খান আতাউর রহমান’, ‘রওশন জামিল’, ‘বেবি জামান’, ‘ব্ল্যাক আনোয়ার’, ‘রাজু আহমেদ’ প্রমুখ।
জহির রায়হান ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। শুধু তাই নয়, কলম আর ক্যামেরা দিয়ে দেশের জন্যও সারা জীবন লড়াই করে গেছেন। জাতি তার এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে চিরদিন মনে রাখবে।