ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ কথা বলেছেন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জনজীবনের সমস্যা, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
আগের সরকারের আমলের ভেঙে পড়া অর্থনীতি কতটা পথে আনা গেল? বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্থনীতির গতি কমবে?
হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতির হাল বুঝতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করলে, মানুষের সঙ্গে কথা বললে একই ফলাফল আসত। অর্থনীতির হালচালের দুটি স্তর আছে। প্রথমটি হচ্ছে একদম চরম বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় আনা। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে অর্থনীতিকে বেগবান করা। দুটি আলাদা কাজ। প্রথমটা প্রশাসনিকভাবে করা সহজতর। যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের বাদ দিয়ে দেওয়া, সুনির্দিষ্ট অপচয়ের খাতগুলো বাদ দেওয়া, রিজার্ভকে একটু স্থিতিশীল করা। এই জায়গায় সরকার কিছুটা সফল হয়েছে। কিন্তু বড় কাজটা হলো অর্থনীতিকে বেগবান করা। এটা শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ দিয়ে সম্ভব নয়। এখানে মূল বিষয়টি হলো অর্থনীতির চাকা যাঁরা ঘোরান, তাঁদের জন্য পরিবেশ তৈরি করা, তাঁদের জন্য প্রণোদনাগুলো কী হবে, সেটা ঠিক করতে হবে, তাঁদের জন্য আস্থার জায়গা তৈরি করা। আমাদের এখানে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তা যাঁরা, এমন নয় যে তাঁরা অর্থের জন্য বসে আছেন। তাঁদের মূল চাহিদা হচ্ছে সরকার যেন একটা আস্থার জায়গা ও ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করে।
আস্থা ও পরিবেশের কথা বলছেন। সুনির্দিষ্টভাবে কী করা হলে আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে?
হোসেন জিল্লুর রহমান: এখানে নিরাপত্তা অবশ্যই একটা বড় বিষয়। চাঁদাবাজি চলে গেছে, এমন বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে না। আবার আস্থার পরিবেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতিই কিন্তু একমাত্র বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, সিদ্ধান্তে গ্রহণে দ্রুততা, প্রয়োজনটা কী, সেটা বুঝে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া—পরিবেশ বলতে আমি কিন্তু এগুলোকে বোঝাচ্ছি। আমরা পিপিআরসি থেকে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতির পাশাপাশি নতুন একটা সূচক উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছি। সাধারণ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চেয়েও সেটা বড় একটা সূচক। এটাকে আমরা বলছি হয়রানি সূচক। শুধু ব্যবসা নয়, রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে হলে নাগরিকদের সব জায়গায় হয়রানির শিকার হতে হয়।
একটা কথা বলা হয়, আমাদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ৫ আগস্ট চলে গেলেও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন তো রয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন—এ ধরনের শব্দের মধ্যে আটকে থাকাটাও একটা সমস্যা। এখানে দুটি বিষয়কে একসঙ্গে দেখা দরকার—অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে মোকাবিলা করা এবং অর্থনীতিকে বেগবান করা। এখানে শুধু শাস্তি ও অপরাধের লেন্স থেকে অর্থনীতিকে দেখলে চলবে না। মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদকে আমরা অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখতে পারি। নিয়মকানুন ভেঙে, সরকারি প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এসে নগদকে সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সেটাও স্থবিরতার মধ্যে পড়ে আছে। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এখানে বুদ্ধিমত্তা, কৌশলী পদক্ষেপ, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগকে বিবেচনায় নেওয়ার ব্যাপার আছে। সাপ্লাই চেইন যাতে ঠিক থাকে, সেটা মাথায় নিয়ে এই কাজগুলো করতে হবে। নীতি পরিচালনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্ষমতার একটা বড় বিষয় এখানে আছে।
পাঁচ মাস পর সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পেরেছে? সরকারের অবস্থানটাকে কীভাবে দেখছেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: ফলাফল দেখলেই অবস্থানটা বোঝা যায়। এখনো আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক ঘাটতি রয়ে গেছে, হয়রানির বিষয়গুলো শোনা যাচ্ছে, চাঁদাবাজিও হচ্ছে। অনেকে বলছেন, দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে। মানে, সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা দুর্নীতি করছেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁরা কাজও করছেন না। সব জায়গাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ক্ষেপণ চলছে। অর্থনীতির শৃঙ্খলা, অর্থনীতিকে বেগবান করা—এ দুটি বিষয়ের সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি জায়গা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে স্বস্তির বিষয়টা। আন্দোলনটার সূচনা হয়েছিল যুব বেকারত্বের কারণে। কিন্তু কর্মসংস্থান কোথায়? এমন নয় যে রাতারাতি সবকিছু পাল্টে দেওয়া যাবে। কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরির জন্য তো সুনির্দিষ্ট কৌশলটা দরকার। সেটা তো দেখছি না। মূল্যস্ফীতিও একটা বড় সমস্যা।
বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে। শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তাও করছে। সরকারকে আমরা পুরোনো পথেই হাঁটতে দেখছি।
হোসেন জিল্লুর রহমান: অন্তর্বর্তী সরকারও সেই পরিচিত পথকেই সহজ পথ হিসেবে বেছে নিতে দেখছি। আমরা অনেক ঋণ নিয়েছি, আন্তর্জাতিক চুক্তি করেছি। এর অনেকগুলো অনৈতিক হলেও আইনি কারণেই সেগুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে আমাদের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এখানেই তো উদ্ভাবনীর বিষয়টা রয়েছে। আরও দ্বিগুণ তেজে সৃজনশীলতা পরিচয় দেওয়ার মুহূর্ত এটি। সেখানে একটা বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকারে যে এতগুলো অভিজ্ঞ লোক জড়ো হয়েছেন, তাঁদের পদচিহ্নগুলো কোথায়?
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যক্তি খাতের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নয়, এটা একটা বাস্তবতা। অর্থনীতির যাঁরা চাকা ঘোরাবেন, তাঁদের প্রয়োজনগুলো কী, সেটা তো শুনতে হবে। ব্যক্তি খাতের সুনির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী শুধু তাদের স্বার্থের জন্য আলোচনা করে। শুধু কিছু চিহ্নিত মুখ নয়, সার্বিকভাবে ব্যবসায়ী মহলকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সে জায়গায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাঁদের কথা শুনলেই আস্থার জায়গাটা শুরু হবে। এখন তো তাঁদের কথা তেমন শোনা হচ্ছে না। তাঁদের দুঃখ-বেদনা, তাঁদের ক্ষোভ, তাঁদের চাহিদা, তাঁদের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ কী—এসব তো তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলেই বেরিয়ে আসবে।
সরকারে তো একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি আছেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিকে সরকারে ঢোকানোটাই কি সমাধান? এটাকে যদি কেউ সমাধান বলেন, তবে এর চেয়ে বড় আমলাতান্ত্রিকতা আর কী হতে পারে। এটা চূড়ান্ত দৃষ্টিসীমাবদ্ধ আমলাতান্ত্রিক সমাধান। এ রকম আমলাতান্ত্রিকতা আমরা প্রায় সবখানেই দেখছি। যেমন জুলাই-আগস্টের হতাহতদের তালিকা এখানে পূর্ণাঙ্গ করা যায়নি। এখানে যাচাই-বাছাই শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু যাচাই-বাছাই খুব সুপরিচিত একটা আমলাতান্ত্রিক শব্দ। এখানেই মনোযোগ আর সদিচ্ছার প্রশ্নটি চলে আসে। অনেকে বলবেন যে সদিচ্ছা তো আছেই। কিন্তু বায়বীয় সদিচ্ছা দিয়ে তো কাজ হবে না। বিপরীতে আমরা দেখছি, পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের তালিকা দ্রুততর সময়ে হয়ে যাচ্ছে, তাঁদের পদোন্নতিও কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এখানে অগ্রাধিকারটা তাহলে কোথায়?
একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনি কি অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো পরামর্শ দিতে চান?
হোসেন জিল্লুর রহমান: আমি আগেই বলেছি, শুধু মুখচেনা কয়েকজন ব্যবসায়ী নন, ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ বৃহত্তর ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই একটা স্ববিরোধিতার মধ্যে ঢুকে গেছে, সেটা নিজেদের আরোপিত স্ববিরোধিতা। সরকারের ভুলটা হলো প্রথম থেকেই আমলাতন্ত্রকে চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছে। একদিকে বলা হচ্ছে বৃহত্তর পরিবর্তনের কথা অথচ চালকের আসনে বসানো হয়েছে তাঁদেরকেই, যাঁদেরকে পরিবর্তন করা এই অভ্যুত্থানের অন্যতম এজেন্ডা।
আপনি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। খাদের কিনারে পড়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার কী আছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান: শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তরণের একটা গুরুত্বপূর্ণ গল্প তৈরি হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ থেকেও ২০০ মিলিয়ন ডলার ধার নিয়েছিল। তারা কিন্তু সেই ধার শোধ করেছে। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও রাজনৈতিক মুখপাত্র নালিন্দা জয়াতিসার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে আমার। নতুন সরকারের বয়স এখন দুই মাস পেরিয়েছে। সেখানে ৪০টি মন্ত্রণালয়কে কমিয়ে ২৪টি মন্ত্রণালয়ে নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতিজনিত সমস্যা এখনো আছে, কিন্তু সেটা একধরনের সহনীয় জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এখানে কিন্তু কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। জনসম্পৃক্ততাকে তারা খুব চমৎকার ও কার্যকর একটা কৌশলে পরিণত করতে পেরেছে। তাদের মন্ত্রিসভা তরুণ; কিন্তু অভিজ্ঞ লোকজনে ভরা। শ্রীলঙ্কা থেকে আমি প্রথম যে শিক্ষাটা নিয়ে এসেছি, সেটা হলো আমরা যদি অর্থনীতিকেও ঠিক করতে চাই, তাহলে অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, যেমন অর্থ উপদেষ্টা, গভর্নর—তাঁরাই একমাত্র ক্রীড়নক নন। এখানে একটা আবহ তৈরি করতে হবে, একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এটা বৃহত্তর একটা কাজ। শ্রীলঙ্কায় এই বৃহত্তর কাজ টিম হিসেবে করা হচ্ছে।
নির্বাচনের সময় ও ধরন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একধরনের বিরোধ, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: তরুণসমাজের একটা অগ্রগামী অংশ রাজনৈতিক দল গড়তে চায়, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। একটি কেন, একাধিক দলও হতে পারে। তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তি আমাদের সমাজের জন্য ইতিবাচকও। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে মানুষের কাছে, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থেকেই একটি রাজনৈতিক দলকে দাঁড়াতে হবে। আমি রাষ্ট্রের সঙ্গে আছি, ক্ষমতার সঙ্গে আছি, সেই সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দল করলাম, সেটা ঠিক নয়।
শেখ হাসিনা কি দোর্দণ্ডপ্রতাপে স্বৈরাচারী শাসন চালাননি? কিন্তু নামহীন মানুষেরাই তো শেখ হাসিনাকে উৎখাত করেছেন। একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাংলাদেশে যাঁরাই রাজনীতি করতে চান বা আগ্রহী, তাঁদের প্রতিনিয়ত জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার পরীক্ষা দিয়েই এগোতে হবে। এটা না করে ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার মানসিকতা নিয়ে কেউ যদি রাজনীতি করতে চান, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক হবে না।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার যে ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে ৪টির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাইছি।
হোসেন জিল্লুর রহমান: সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ইতি-নেতি বিচারের চেয়ে আমি দেখতে চাই কমিশনগুলো কোন কোন সমস্যাকে আমলে নিয়েছে, সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনমনে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এতে তার প্রতিফলন ঘটেছে কি না। সেখানে একটি ছিল এককেন্দ্রিক ক্ষমতা। আরেকটি হলো কীভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে যে এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো তৈরি হয়েছিল, সেটা কীভাবে দূর করা যায়। এর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নটিও জড়িত। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করেও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা যায়। এককেন্দ্রিকতা না হওয়ার জন্য সেটি জরুরি। ২০১৫ সালে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন চালু করে এর কার্যকারিতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
এ কারণেই রাজনৈতিক নবায়নের প্রশ্ন এসেছে। সরকারি কাঠামোয় নবায়ন হলো একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা আছে। কিন্তু ওটা কার্যকর থাকলে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হতো না। নবায়নটা রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন দরকার, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও। নতুন নেতৃত্বের সোপান তৈরি করা জরুরি। সার্বিকভাবে সমাজে বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। সবার জন্য সুযোগ তৈরি করা। এখানে তরুণ নেতৃত্ব গঠনের প্রশ্নটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি যেসব আকাঙ্ক্ষার কথা বললেন, ধরে নিলাম কমিশনের প্রতিবেদনে সেটা থাকল। কিন্তু বাস্তবায়ন হবে কীভাবে?
হোসেন জিল্লুর রহমান: এ জন্য আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আমাদের বিশাল আমলাতন্ত্র আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি পরিকল্পনায় তো উন্নয়ন সহযোগীদের হস্তক্ষেপই বেশি দেখি। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যাপক উপস্থিতি। এটা আলোচনায় নেই; কিন্তু থাকা উচিত ছিল। বিশ্বমঞ্চে নিজের অবস্থান সংহত করতে হলে আমার সক্ষমতা খুবই জরুরি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির যে জঞ্জাল, সেটাও দূর করতে হবে।
আমাদের পেশাজীবী সংগঠন দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তারা পেশাগত দক্ষতার চেয়ে কোটারি স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যস্ত থাকে। এটা কেতাবি প্রস্তাব দিয়ে সরানো যাবে না। এই পাঁচ সূচকের মধ্যে কোনটি কেতাবি, কোনটি বাস্তবায়ন করা জরুরি আর কোনটি নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে—সেটাও ভাবা দরকার। অনেকগুলো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য নেই। এই যে সরকার এসে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো বাতিল করে দিল, এর মাধ্যমে আমলাদের ওপরই বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হলো।
আবার সরকার অনেক ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ করা হয়েছিল। পুলিশের ক্ষমতাকে বাড়ানোর জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার সেটি একীভূত করে ফেলেছে। আরও অনেক ক্ষেত্রে করা যেত; কিন্তু সরকার করেনি। সংস্কার প্রস্তাবের কিছু কিছু এখনই করে ফেলা যায়। কিছু কিছু নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে।
রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু কমিশনের প্রতিবেদনে তো নানা পরামর্শ ও সুপারিশ আছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের কথা বলা হয়েছে, যা অনেকটা কেতাবি মনে হয়েছে। এটা বাইরে থেকে হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আরও প্রশিক্ষণ ও দক্ষ করে তোলার উদ্যোগ প্রয়োজন।
আপনি যখন রাজনৈতিক দলের নবায়নের কথা বলছেন, তখন বাস্তবে তো দখলবাজি বন্ধ হয়নি। পুরোনো মুখের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান: দখলবাজি কেন চলবে? সরকারেরই দায়িত্ব এই দখলবাজি বন্ধ করা। পুলিশ কোথায়? সরকারের পক্ষ থেকে তো বার্তা দিতে হবে যে এসব এখন চলবে না। সরকার তো দুর্বল নয়। তাদের পেছনে সমগ্র জাতির অলিখিত ম্যান্ডেট ছিল। তারা সেটা সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। কেবল চাঁদাবাজি নয়, আরেকটি বিষয় হলো পছন্দের লোককে বসিয়ে দেওয়া। আবারও মেধার বিষয়টি পেছনে চলে গেছে। আমলাতন্ত্রকে চালকের আসনে বসানোর কারণেই এটা হয়েছে।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশন বয়সসীমা কমিয়ে ২১ বছর করার কথা বলেছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান: এ ক্ষেত্রে বিতর্ক আছে যে এটা ছাত্রনেতাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য করা হয়েছে কি না। এরপরও দেখলাম, বেশ কিছু দেশে আছে। এ বিষয়ে জোরালো ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। তবে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়েছে। এটা আবার কোটার মধ্যেই চলে গেল। কোটার সমস্যা হলো এটি যে উদ্দেশ্যে করা হয়, সেটি পূরণ হয় না। তরুণদের অবশ্য প্রাধান্য দিতে হবে, তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
একই সঙ্গে তাদের যোগ্য করে তুলতে হবে। একদিকে শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল, অন্যদিকে তরুণদের ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। প্রস্তাবের মধ্যে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে যে তরুণেরা যেন ক্ষমতার ভাগীদার হয়। এটা বিতর্ক তৈরি করবে। তরুণেরা শুরুতে কিন্তু রাজনৈতিক লিটারেসি বা শিক্ষার কথা বলেছিলেন। তরুণদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সেটা ক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে। কিন্তু শুধু ক্ষমতার ভাগীদার করতে নয়। এটা তৈরি করার দায়িত্ব রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের। সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে তরুণদের তৈরি করার দায়িত্ব আমাদেরও। পিপিআরসি কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ৫ আগস্টের আগে নাগরিক সমাজ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যতটা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল, এখন তো তাদের সেই ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না।
হোসেন জিল্লুর রহমান: এর একটা বড় কারণ, নাগরিক সমাজের অনেকে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ওটা ভালো কাজ। কিন্তু নাগরিক সমাজের প্রধান দায়িত্ব তৃণমূল মানুষ ও সমাজের প্রয়োজনগুলো জোরালোভাবে উচ্চারণ করা। এখন বলিষ্ঠ ও স্বাধীন নাগরিক কণ্ঠস্বর পিছিয়ে পড়েছে। এতে আমাদের মনোযোগ কম। নাগরিক সমাজ কেবল পরামর্শ দেবে না। তারা রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দেবে কোথায় ঘাটতি হচ্ছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।