
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং গভর্ন্যান্স (সুশাসন) চালু করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন জরুরি। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দেওয়াও অযৌক্তিক। তবে নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো শঙ্কা দেখছেন না। কিন্তু চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রোববার দুপুরে তিনি যুগান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তরও দেন। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে দেশের চলমান পরিস্থিতি, জাতীয় নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কার, জামায়াত প্রসঙ্গ, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের লক্ষ্য, নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ, বিচার প্রক্রিয়াসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার তারিকুল ইসলাম।
যুগান্তর : নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল : বিএনপির অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুব দ্রুত চাই। সংস্কারও চাই। সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব লিখিতভাবে সংস্কার কমিশনে দিয়েছি। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার করে দিয়েছি। খুব স্পষ্ট করে বলেছি, যে সংস্কারগুলোয় সব দল ঐকমত্য হবে, আমরা সেগুলোর চার্টারে (সনদ) স্বাক্ষর করতে রাজি আছি। যার ওপর ভিত্তি করে আমরা নির্বাচনের দিকে চলে যেতে পারি। বাকি সংস্কারগুলো নিয়ে নির্বাচিত সরকার সংসদে কথা বলবে।
যুগান্তর : নির্বাচন ও সংস্কারকে মুখোমুখি করার কথা উঠে এসেছে কিছু বিশ্লেষকের বক্তব্যে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
মির্জা ফখরুল : বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কার বিএনপির হাত দিয়েই শুরু হয়েছে। সবার আগেই ৩১ দফা রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আমরা অনেকেই অনেক কিছু ভুলে যাই। একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাষ্ট্র সংস্কারের ‘ভিশন-২০৩০’ দিয়েছেন। তাই সংস্কার কোনো নতুন বিষয় নয়। আমরা সংস্কারের প্রস্তাবনায় মতামত দিয়েছি। আমরা বলেছি, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনটা হওয়ার প্রধানত দুইটি কারণ। একটি হচ্ছে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, আরেকটা হলো গভর্ন্যান্স (সুশাসন) চালু করা।
যুগান্তর : ২০২৩ সালে ৩১ দফা দিয়েছিল বিএনপি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশ মৌলিক সংস্কারের প্রধান প্রস্তাবক যদি বিএনপি হয়, তবে কেন প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে বিএনপি সংস্কার চায় না?
মির্জা ফখরুল : যারা ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন, তাদের একটা অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা বিএনপিকে যেন একটু রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারে এবং বিএনপি যেহেতু সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি; সেটা যেন না হয়, সে কারণে এটা করা হচ্ছে।
যুগান্তর : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে অনেকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছেন। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল : প্রশ্নই আসে না। একাত্তর ও চব্বিশ কি এক হতে পারে। একাত্তর ছিল একটা জাতির সৃষ্টির জন্য লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভূখণ্ডের জন্য লড়াই। স্বাধীনতার জন্য লড়াই। সেটা অনেক বড় ব্যাপার। একই সঙ্গে চব্বিশ ছিল ফ্যাসিষ্ট শাসকের হাত থেকে মুক্তির লড়াই। যে কারণে দুটোকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী? এছাড়া আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মির্জা ফখরুল : একটা পত্রিকায় দেখলাম নতুন যে দলটি হয়েছে তাদের একজন এ ইস্যুতে ইতোমধ্যে পদত্যাগও করেছেন। আমাদের দলের মধ্যে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার খবর আমার কাছে নেই। একটা কথা সবার বিশ্বাস রাখা দরকার, যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। বিচারের আগে কীভাবে ফিরে আসবে, এটা আমার বোধগম্য নয়। তবে আমরা এই কথা বলে আসছি যে, কোন পার্টি নিষিদ্ধ হবে, কোন পার্টি কাজ করবে, কোন পার্টি কাজ করবে না-এর সিদ্ধান্ত আমরা নেব না। জনগণ এর সিদ্ধান্ত নেবে। জনগণ নির্ধারণ করবে কোনো পার্টি থাকবে কি থাকবে না, কোনো পার্টি নির্বাচন করবে কি করবে না। জনগণকে এ সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
যুগান্তর : বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারের অবস্থানে আপনারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে কী কী যুক্তি ছিল?
মির্জা ফখরুল : নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের যুক্তি স্পষ্ট। এটা নিয়ে এত অস্পষ্টতা আসছে কোথা থেকে। বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন, তাও বুঝি না। নির্বাচনই একমাত্র পথ, যে পথে জনগণ তার প্রার্থীকে নির্বাচিত করে দেশ শাসনের জন্য, তার প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে পাঠাতে পারে। সংসদে সংবিধান সংশোধন, আইন তৈরি করা-সব অধিকার থাকে, এটা একটা দিক। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির মধ্যে আনার ক্ষমতাও থাকে। সেখানে অসুবিধাটা কোথায়? নির্বাচন না হলে কে দেশ চালাবে? আমরা কিন্তু কখনো সময় বেঁধে দিইনি। আমরা বারবার বলে আসছিলাম, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিন। আরও আশা করেছিলাম, সরকার একটা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেবে। সরকার তা দেয়নি। যে কারণে এবার মনে করেছি, সরকার আমাদের খুব হতাশ করেছে। মনে হয়েছে, সরকারের রোডম্যাপ না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না, এটা অযৌক্তিক।
যুগান্তর : নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছেন কি না?
মির্জা ফখরুল : আমি নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো শঙ্কা দেখি না।
যুগান্তর : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো মতপার্থক্য দেখছেন?
মির্জা ফখরুল : কিছু মতপার্থক্য তো আছেই। এর মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ নিয়ে যা হচ্ছে, সেটিকে একধরনের মতপার্থক্য বলতে পারেন। তবে বাস্তবতা হলো, সরকার তো এখানো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করছে না। যদিও বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তা চাচ্ছে। এখানে সরকারও নির্বাচন দিতে চায়। কিন্তু সমস্যা হলো সময় নির্ধারণ নিয়ে।
যুগান্তর : জামায়াতে ইসলামী আগের অবস্থান পরিবর্তন করে আগামী রোজার আগে নির্বাচন চেয়েছে। এটি লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাতের ফল বলে অনেকে বলছেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন।
মির্জা ফখরুল : এটা আমি বলতে পারব না। কারণ, আমার এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
যুগান্তর : বিএনপির সঙ্গে জামায়াত বা এনসিপির জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
মির্জা ফখরুল : আপাতত জোটের ব্যাপারে কারও সঙ্গেই কোনো আলোচনা করছি না।
যুগান্তর : ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এর লক্ষ্য কি নির্বাচন?
মির্জা ফখরুল : লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের ব্যাপারে একটা মতৈক্য সৃষ্টি করা।
যুগান্তর : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় সময়ই দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলে থাকেন যে আগামী নির্বাচন এবং আগামী দিনের রাজনীতি বিএনপির জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জগুলো কী?
মির্জা ফখরুল : স্বাভাবিকভাবে এখন রাজনীতি চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। কারণ, বিভিন্ন মত ও পথ এসেছে এবং নতুন যে দলটি তৈরি হয়েছে, তারা নতুন নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে এসেছে। আবার পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারও বিভিন্ন রকম অপকৌশল অবলম্বন করছে। এজন্য তিনি (তারেক রহমান) চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন।
যুগান্তর : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন চলছে। এ থেকে উত্তরণের পথ কী মনে করেন।
মির্জা ফখরুল : প্রথমত যেটা হওয়া উচিত, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা পুরোপুরি নির্ভর করবে ভারতবর্ষের আচরণের ওপর। সে কীভাবে বাংলাদেশকে দেখছে, কীভাবে সে ডিল করছে, এর ওপর। যদি ভারত মনে করে, বাংলাদেশ তার অধীন একটা রাজ্য, তাহলে ভুল হবে। আর তারা যদি মনে করেন, শুধু একটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের (ভারতের) সম্পর্ক করতে হবে; তাহলে তারা (ভারত) ভুল করবে। ইতোমধ্যে সেই ভুলটা হয়েছে। এজন্যই আমি বারবার বলে আসছি, আমাদের যেমন একক কোনো বন্ধু থাকা উচিত নয়, ঠিক একইভাবে ভারতবর্ষেরও একক একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা কোনোমতেই সমীচীন হতে পারে না। এখানে জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক হতে হবে।
যুগান্তর : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন?
মির্জা ফখরুল : যতদূর শুনেছি দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এ মাসের মধ্যেই দেশে ফিরতে পারেন। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কয়েকটি মামলা এখনো বাকি আছে। মামলা শেষ হলেই চলে আসবেন।
যুগান্তর : ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালে গুম-খুন ও গণহত্যার বেশকিছু মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত ও বিচারে সময়ক্ষেপণের মতো কিছু দেখছেন কিনা?
মির্জা ফখরুল : এ ব্যাপারে সরকারের কিছুটা ধীরগতি আছে, ব্যর্থতাও আছে। তবে আরও সক্রিয় হতে হবে। তাদের দ্রুত ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। তা না হলে বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে না।
যুগান্তর : নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত কি না? প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে কাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে?
মির্জা ফখরুল : বিএনপি সবসময়ই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে যারা বেশি জনপ্রিয়, তাদেরই প্রার্থী নির্ধারণে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে।
যুগান্তর : আপনি একজন পরিচ্ছন্ন ও সজ্জন রাজনীতিক হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে আপনাকে ১২ বার কারাগারে নেওয়া হয়েছে, অসংখ্য দিন রিমান্ডেও ছিলেন। দেশ ও দলের জন্য আপনার এ ত্যাগকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মির্জা ফখরুল : যা কিছু করেছি, সব দেশের জন্য। কারণ, আমি দেশকে ভালোবাসি। আর দল তো আমার প্রেরণার উৎস। শত প্রতিকূল অবস্থায় দলকে কেউ ভাঙতেও পারেনি। এছাড়া ছোটবেলা থেকেই দেশের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। ছাত্ররাজনীতি করেছি, রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতিই আমার প্রাণ।
যুগান্তর : নানা ত্যাগ থাকলেও রাজনীতিকদের সমালোচনা পিছু ছাড়ে না। সেক্ষেত্রে আপনার বিরুদ্ধে সমালোচনাকে কীভাবে দেখেন।
মির্জা ফখরুল : জবাব তো একটাই। রাজনীতিক যারা, তাদের নিয়ে কিছু আলোচনা ও সমালোচনা তো থাকবেই। কেউ ভালো বলেন, কেউ মন্দও বলেন। এটা আমি কিছু মনে করি না। বরং আমি মনে করি, জনগণের জন্য আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের সমালোচনা করলে তা ধৈর্য, প্রজ্ঞা, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে ফেস করা উচিত।
যুগান্তর : সময় দেওয়ার জন্য যুগান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল : আপনাকে এবং যুগান্তরের সব পাঠককে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।