বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব বিদেশি কর্মীদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন ও প্রণোদনা কমিয়ে আনছে। একসময় উচ্চ বেতনের আশায় নির্মাণ, উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বের মেধাবীরা দেশটিতে ভিড় জমাতেন। কিন্তু ব্যয় সংকোচন এবং অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাসের ফলে নিয়োগকর্তারা এখন বেতনের প্যাকেজ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন বলে জানিয়েছে দেশটির চারটি নিয়োগকারী সংস্থা।
সৌদি আরবের অর্থনৈতিক রূপান্তরের পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’-এর অর্ধেক পথ অতিক্রম হলেও, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিলম্বের চাপ দেশটিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বছর দুয়েক আগেও বিদেশি কর্মীরা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত বেতন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়তি সুবিধা আলোচনার মাধ্যমে আদায় করতে পারতেন। এখন সেই সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
দুবাইভিত্তিক নিয়োগ পরামর্শক সংস্থা টাস্কান মিডল ইস্টের সিইও হাসান বাবাত জানান, আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার সৌদি আরবে ৬০ হাজার ডলারের পরিবর্তে প্রায় ১ লাখ ডলার বেতনের প্রস্তাব পেতেন। কিন্তু বর্তমানে ব্যয় সংকোচন শুরু হওয়ায় নিয়োগকর্তারা আগের তুলনায় বেশি দর-কষাকষি করছেন।
নিয়োগকারী সংস্থা বয়ডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাগদি আল জেইন বলেন, "একদিকে এই অঞ্চলের বৃহত্তম অর্থনীতি ব্যয়কে যৌক্তিক পর্যায়ে আনছে, অন্যদিকে প্রচুর কর্মী এই অঞ্চলে আসতে আগ্রহী।" এর ফলে নিয়োগকর্তারা বেতন প্যাকেজ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন।
দুবাইভিত্তিক কুপার ফিচের সিইও ট্রেফর মারফি বলেন, এখন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেতনের পার্থক্য খুবই কম—গড়ে মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ।
এই পরিবর্তন সৌদি আরবের ৯২৫ বিলিয়ন ডলারের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (পিআইএফ) বৃহত্তর কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের প্রতিফলন।
পরিবর্তিত অগ্রাধিকার: অবকাঠামো ও রিয়েল এস্টেটনির্ভর মেগা প্রকল্পগুলোয় ধাক্কা খাওয়ার পর তহবিলটি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), লজিস্টিকস ও খনির মতো খাতে গুরুত্ব দিচ্ছে, যেখান থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো রিটার্ন পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
বিলম্বিত প্রকল্প: মরুভূমিতে পরিকল্পিত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ভবিষ্যৎ নগরী ‘নিওম’ এবং পার্বত্য পর্যটনকেন্দ্র ‘ট্রোজেনা’-সহ পিআইএফ-সমর্থিত উদ্যোগগুলো বিলম্বের মুখে। কামকো ইনভেস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালেও সৌদি প্রকল্পের গতি মন্থর ছিল।
তেলের চাপ: তেলের নিম্ন দাম সরকারি অর্থায়নে চাপ বাড়িয়েছে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, বাজেট ভারসাম্য বজায় রাখতে সৌদি আরবের তেলের দাম প্রায় ১০০ ডলারের কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন।
স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি
বেতন প্যাকেজ কমলেও সৌদি আরব এখনো অঞ্চলের বাইরের দেশগুলোর জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য, বিশেষ করে যেখানে চাকরির সুযোগ কম। তবে বেসরকারি খাতে সৌদি নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকার শ্রমবাজার সংস্কার ও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়েছে।
দুবাইয়ের ম্যাচেস ট্যালেন্টের সিইও লুইস নাটসন বলেন, "বেতন প্যাকেজগুলো এখন অনেক বেশি পরিমিত, যা ডেটা, কর্মক্ষমতা ও বাস্তব বাজার বেঞ্চমার্কের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হচ্ছে। কারও কাছে এটি সংকোচন মনে হতে পারে, তবে আমার কাছে এটি পরিপক্বতার লক্ষণ।"
তিনি পরামর্শ দেন, সেরা মেধাবীদের আকর্ষণ করতে কোম্পানিগুলোকে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিফলিত করে এমন পূর্বানুমানযোগ্য প্যাকেজ এবং পরিবারের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাত্রার সুযোগ তুলে ধরতে হবে।
অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত করমুক্ত উচ্চ বেতন, উন্নত আন্তর্জাতিক স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা এবং উদার জীবনযাত্রার কারণে এখনও অনেক দক্ষ কর্মীর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। বয়ডেনের মাগদি আল জেইন বলেন, "সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে লোকজনকে সৌদি আরবে স্থানান্তরে রাজি করানো এখন একটি চ্যালেঞ্জ। তারা উচ্চ প্রিমিয়াম প্রত্যাশা করে।"