মিয়ানমারের সামরিক সরকার আগামী মাসে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ওই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সামরিক সরকার (জান্তা)।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়ে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য মিয়ানমার অনুরোধ জানিয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনকে’ বৈধতা দেওয়ার পরিকল্পনা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের। তাই এই অনুরোধে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে নীরবতা পালনের নীতিতে হাঁটতে চায় বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের জান্তা সরকার এই প্রথম নির্বাচন দিতে যাচ্ছে। দুই ধাপে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রথম পর্ব আগামী ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। আর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রায় ৫৫টি দল নির্বাচনে নিবন্ধন করেছে। তাদের মধ্যে ৯টি দল দেশব্যাপী আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো আসন্ন নির্বাচনকে ক্ষমতা ধরে রাখতে মিন অং হ্লাইংয়ের একটি প্রতারণা হিসেবে দেখছে।
এর আগে দেশটি সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২০ সালের ভেম্বরে। অং সান সু চির দল ওই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা গ্রহণ করে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এরপর দেশটিতে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভ ব্যাপক সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে মিয়ানমারের অনুরোধে বাংলাদেশ চুপ রয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবগুলো দেশেই চিঠি দিয়ে পর্যবেক্ষক চেয়েছে মিয়ানমার। পর্যবেক্ষক নিয়ে আসার মাধ্যমে মূলত নির্বাচনের বৈধতা খুঁজছে জান্তা সরকার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈধতা লাভের আশায় মরিয়া হয়ে একটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের জনগণের পাশে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাৎক্ষণিক, অর্থবহ পদক্ষেপ হলো জান্তা যেটিকে ‘নির্বাচন’ হিসেবে উপস্থাপন করছে, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করা ও নিন্দা জানানো।
বৈধতা পেতে মরিয়া জান্তা: জাতিসংঘ
এদিকে জান্তা সরকারের অধীন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটিকে পাতানো নির্বাচন হিসেবে দেখছে জাতিসংঘও। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকে গত ২০ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে এক ভয়াবহ মানবিক ও মানবাধিকার সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে ব্যর্থ হয়েছে জান্তা সরকার। ফলে জান্তা এখন একটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। ডিসেম্বরে শুরু হতে যাওয়া নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হবে না।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে; জান্তা বা নির্বাচনের সমালোচনা করা অবৈধ মনে করা হয় এবং সত্য প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের কারাগারে থাকতে হয়, এমন একটি পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈধতা লাভের আশায় মরিয়া হয়ে একটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের জনগণের পাশে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাৎক্ষণিক, অর্থবহ পদক্ষেপ হলো জান্তা যেটিকে ‘নির্বাচন’ হিসেবে উপস্থাপন করছে, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করা ও নিন্দা জানানো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং মৌলিক স্বাধীনতার ওপর জান্তার অবিরাম আক্রমণ এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। সাবেক স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। দেশের ২২ হাজারের বেশি রাজনৈতিক বন্দীর মধ্যে অনেকেই সাবেক রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কর্মী।
কোন দেশ কী বলছে
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পাতানো নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের অবস্থান অস্পষ্ট। গত আগস্টে চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন যে সব পক্ষের অংশগ্রহণে মিয়ানমারে একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভারত মিয়ানমারে ‘পর্যবেক্ষক দল’ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
তবে জুলাই মাসে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন হাজি হাসানে বলেছেন, আসিয়ানভুক্ত মন্ত্রীরা মিয়ানমারকে পরামর্শ দিয়েছেন যে নির্বাচন আপাতত অগ্রাধিকার নয়। অগ্রাধিকার হলো সব সহিংসতা বন্ধ করা, যাতে সব পক্ষ একসঙ্গে বসতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘আংশিক নির্বাচনের কোনো মানে হয় না। এতে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে
জান্তার নির্বাচনী পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাপান। দেশটি মনে করে, এতে মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
এদিকে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন হয়। সেখানে ভাষণ দেওয়ার সময় জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এবং বেশ কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্র জান্তার নির্বাচনী পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন।