
যুদ্ধ চলছে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে, কিন্তু পেন্টাগনের নজর এশিয়ার দিকে। সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে জিডিপির ৩.৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় ব্যয়ের জন্য রাজি করিয়েছেন পেন্টাগনের কর্তারা। এ ছাড়া এসব দেশ প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অবকাঠামোতে জিডিপির ১.৫ শতাংশ ব্যয়েও রাজি হয়েছে। এবার এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় নিজেদের চাহিদামতো বানাতে চাইছে মার্কিন হর্তাকর্তারা। তবে এ ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে পারে আমেরিকা।
ন্যাটোর কৌশল এশিয়ায় প্রয়োগের কারণ হিসেবে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কৌশল সারা বিশ্বের জন্যই এখন প্রযোজ্য। ন্যাটোর মতো প্রতিরক্ষায় ব্যয় জিডিপির ৩.৫ শতাংশ করতে হলে এশিয়ার মার্কিন মিত্রদের বছরে ১৫০ বিলিয়ন ডলার কিংবা এর বেশি অর্থ বাজেটে যোগ করতে হবে। গত ৫০ বছরে একবারও এত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাজেটে যুক্ত করেনি এশিয়ার কোনো মার্কিন মিত্র। এ ছাড়া আমেরিকার এই চাহিদা বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে। আর তা হলো–সঠিক বাজেট স্তর কী, মিত্রদের কীভাবে অর্থ ব্যয় করা উচিত এবং তারা কি তা মেনে চলবে?
আমেরিকা আসলে কী চায়?
নিরাপত্তা ইস্যুতে এশিয়ায় আমেরিকার মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাঁচ দেশ হলো–অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে। এরই মধ্যে তাদের বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষা ব্যয় যাতে জিডিপির ৩.৫ শতাংশ করা হয়, আর তা যেন কার্যকর হয় দ্রুত। এ নিয়ে পেন্টাগন আলাপ করতে চাইলে অস্ট্রেলিয়া ও জাপান কিছুটা আপত্তিই জানিয়েছে। তাদের মতে, সার্বভৌম দেশের বাজেট‑সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আমেরিকা সীমা অতিক্রম করছে।
এর বাইরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আরও কিছু চাইছে। ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হয়েছে, অন্যান্য মিত্রদের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। তবে মনে হচ্ছে, এসব দেশের ওপর চাপ কম। দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ২.৬ শতাংশ ব্যয় করছে, যা এই পাঁচ মিত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদের মধ্যে ফিলিপাইন প্রতিরক্ষায় সবচেয়ে কম ব্যয় করে। ফলে ৩.৫ শতাংশে পৌঁছাতে এদের বেশ বেগ পেতে হবে। অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ১০ শতাংশ ব্যয় করা উচিত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্সএসব ব্যাপারে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনায় এখন সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে পেন্টাগনের কর্মকর্তা এলব্রিজ কোলবিকে। কিন্তু পলিসি বিভাগে ‘আন্ডারসেক্রেটারি’ হিসেবে তাঁর নিয়োগ নিয়েই বরং এর চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সমর্থনেই এই পদে এসেছেন তিনি। এ কারণে প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে আলোচনার আগে এশিয়ার মিত্ররা একটা প্রশ্ন রাখছেন–এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন আসলে কী চাইছে?
এই আলোচনায় বছরের পর বছর লাগাটাই স্বাভাবিক। এ কারণে কোলবির কৌশলের সমালোচনা করছেন অনেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক। তাঁরা বলছেন, এই লম্বা সময়ে এশিয়ার ভেতর অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে। ততদিনে চীনকে হয়তো আর টেক্কা দেওয়া যাবে না। তাঁদের মতে, এসব কৌশল প্রয়োগ না করে বরং চলমান পদক্ষেপগুলো নিয়েই আমেরিকার এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বিশাল অংকের চাহিদাপত্র দিয়ে এখন আবার পিছু হটাটা সঠিক সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে।
আমেরিকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত জুনে এসব ব্যাপারে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল জাপানের সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তাদের। কিন্তু জাপানের পক্ষ থেকে এই বৈঠক বাতিল করা হয়। কারণ, এই বৈঠকের আগেই পেন্টাগন থেকে টোকিওকে জানানো হয়, প্রতিরক্ষা বাজেট যেন ৩ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ শতাংশ করা হয়। জাপানের এই পদক্ষেপকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছে না পেন্টাগন। তারা বলছে, বাইডেন প্রশাসনের সময় তো এমন আলোচনার ধারেকাছেও যায়নি আমেরিকা। এ কারণে এসব বৈঠক করতে দ্বিতীয়বার ভাবছে মিত্ররা।
শুধু প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতেই বলছে না আমেরিকা, তাইওয়ান ইস্যুতে প্রতিরক্ষায় আমেরিকার পাশে থাকতে বলা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে। এমনকি এই ইস্যুতে জাপানের অবস্থানও আরও পরিষ্কার জানাতে বলেছে ওয়াশিংটন। ফিলিপাইনকে বলা হচ্ছে, তাদের এলাকায় যেন নতুন সমরাস্ত্র বসাতে দেওয়া হয়। এর বাইরে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হয়েছে, মার্কিন বাহিনীর জন্য যাতে সুবিধা আরও বাড়ায়। আর আমেরিকার এসব চাহিদা তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা বিষয়ে আরও ভাবিয়ে তুলছে।
এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে মার্কিন মিত্রদের চিন্তাভাবনায়। এসব এলাকার নেতারা এখন ভাবছেন, একসময় হয়তো আমেরিকা তাদের ছেড়ে চলে যাবে। তাদের ভয়, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো চুক্তি করে ফেলতে পারেন। এতে করে একা চীনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে তাদের। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার ভয়টা অন্য জায়গায়। দেশটির নেতারা ভাবছেন, আমেরিকা অকাস সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করে দিতে পারে।
এশিয়ার মিত্ররা কী ভাবছে
আমেরিকা ইস্যুতে বলা যেতে পারে, নিজেদের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে ন্যাটোর দেশগুলো আমেরিকার ওপর এতটা নির্ভরশীল নয়। এদের অনেকের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, বাকিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এরই মধ্যে শক্তিশালী। অন্যদিকে এশিয়ার এসব মিত্রদের কারও পরমাণু অস্ত্র নেই। এ কারণে আমেরিকার ছাতার নিচে থাকতে হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রতিরক্ষায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অনেকটা এগিয়ে গেলেও ইউরোপের দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে। এ কারণে দিন যত যাচ্ছে, আমেরিকার কাছ থেকে আরও অস্ত্র কিনছে তারা।
তাইওয়ান ইস্যুতে প্রতিরক্ষায় আমেরিকার পাশে থাকতে বলা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে। ছবি: রয়টার্সএই ব্যাপারটিই বারবার বলে আসছে এই পাঁচ মিত্র। কিন্তু আমেরিকার চাওয়া এখন আর এই অস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এককালীন থেকে এখন বাৎসরিক ব্যয়ের দিকে হাঁটতে চাইছে তারা। কিন্তু মিত্ররা বলছে, এভাবে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হলে হয় কর বাড়াতে হবে, নতুবা সামাজিক ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।
এটা করতে গেলে জাপান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো সংকটে পড়বে। অনেক চেষ্টা করলে তাইওয়ান হয়তো ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৩.৫ শতাংশ করতে পারবে। এমনটাই মনে করছেন বারাক ওবামা ও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাইওয়ান ইস্যুতে কাজ করা পেন্টাগনের কর্মকর্তা ড্রিউ থমসন। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, তাইওয়ানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত দারুণ। এ ছাড়া চীনা হুমকির কারণে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো একরকম বাধ্যতামূলক।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতি বেশ বড় ফ্যাক্টর। তাইওয়ানে বিরোধী দল আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা আশঙ্কা করছে যে, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি চীনকে আরও আগ্রাসী করে তুলবে। জাপানে একটি ‘অজনপ্রিয় সরকার’ কর কমানোর আহ্বান জানিয়ে বারবার বিরোধী দলের মুখোমুখি হচ্ছে। এদিকে, অস্ট্রেলিয়ায় লেবার সরকার আর্থিক বিচক্ষণতার জন্য নিজেদের সুনাম বজায় রাখতে কিছু বড় নতুন সামাজিক কর্মসূচি আনছে।
আমেরিকা কি ‘অস্ত্রের খেলায়’ জিতবে?
এশিয়া থেকে আমেরিকা যা চাইছে, তা পুরোপুরি মিলবে না বলে মনে করছেন অধিকাংশ বিশ্লেষক। এমনকি মিত্র দেশগুলোর কর্মকর্তারাও একই আভাসই দিয়েছেন। সেটা হলে আমেরিকার পুরো কৌশলই ভেস্তে যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানেজ। ছবি: রয়টার্সপাঁচ মিত্রের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন অনেক কম। আর সেখানকার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানেজ তাঁকে সমর্থন জানিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান আরও নড়বড়ে করছেন। বাকি সব মিত্রদের কাছে ট্রাম্প এর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এতটা জনপ্রিয় নয় যে, সেখানে তিনি জোর করে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে দিতে পারবেন। এ কারণে মার্কিন চাহিদা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কিন হর্তাকর্তারাই।
তবে পেন্টাগন এসব মানতে নারাজ। এক মার্কিন কর্মকর্তা বলছেন, পেন্টাগনের কথামতো না চললে মিত্ররা বেইজিংয়ের কাছে নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এটা করলে তারা নিজেদের বড় ক্ষতি করে ফেলবে। তাঁর কথা হয়তো সত্য হতে পারে। কিন্তু মিত্ররা আমেরিকার মতো ভাববে, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।